আবদুচ ছালাম: `শেখ রাসেল নির্মলতার প্রতীক, দুরন্ত প্রাণবন্ত নির্ভীক’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে বিদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। গত বছর থেকেই শেখ রাসেলকে স্মরণ করে তার জন্মের তারিখটিকে জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। দিনটি ছিল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। বাংলার মানুষের চরম উৎকন্ঠার সময়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন্নেসার ঘর আলোকিত করে জন্মেছিলেন রাসেল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তখন সন্নিকটে। রাসেলের পিতা ছিলেন নির্বাচনী কাজে খুবই ব্যস্ত। স্বৈরাচার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় মোর্চা গঠন করে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করা হয়েছে ফাতেমা জিন্নাহকে। দলীয় মিটিং, সমাবেশের জন্য শেখ মুজিবর রহমান তখন চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। স্বামী মুজিবের কাছে বার্ট্র্যান্ড রাসেলের লেখনীর ব্যাখ্যা ও ফিলোসফি শুনে শুনে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবও রাসেল এর ভক্ত হয়ে ওঠেছিলেন। তাই পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী বিশ্বনেতা, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বার্ট্র্যান্ড রাসেলের নামানুসারে তার সদ্যজাত শিশুটির নাম রাখেন রাসেল।
শিশু রাসেলের বেড়ে ওঠার সময়টাতেই তার কিছু অসাধারণত্ব ধরা পড়ে। সাধারণত কোন শিশু হাঁটতে শেখার প্রথম দিকে কয়েক কদম হেঁটেই বসে পড়ে। কিন্তু রাসেল প্রথম যে দিন হাঁটতে শুরু করেন, অনেকটা সারা বাড়িময় বিরামহীন হেঁটেছেন। তাকে খাবার দিলে তিনি কখনোই সবটা নিজে খেতেন না। বাসায় একটা কুকুর ছিল, সেই কুকুরটাকে তিনি তার খাবার থেকে ভাগ দিতেন।
ধানমন্ডির বাসা ও টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের বাড়িতে সব সময় শত শত কবুতর পোষা হত। শিশু রাসেল কবুতরগুলোর পিছন পিছন ছুটতেন, খেলতেন ও তাদের খাবার খাওয়াতেন। বাড়ির পোষা পশু-পাখিদের সাথে তার ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ও মমত্ববোধ। তাই কখনো বাড়িতে কবুতরের মাংস কিংবা স্যুপ তৈরি করা হলে শিশু রাসেলের মন খারাপ হত। কখনোই তিনি এসব মুখে তোলেন নি। বাসার কুকুর টমি সজোরে ঘেউ ঘেউ করলে রাসেল খুব কষ্ট পেতেন। তিনি ভাবতেন, কোন কারণে টমি বুঝি তার উপর রাগ করেছে ও তাকে বকাবকি করছে।
শেখ রাসেলের বড় আপু হাসু’পা তথা শেখ হাসিনার স্মৃতিকথা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ থেকে আমরা তার বিকশমান অসাধারণ কিছু গুণ ও মানবিকতার কথা জানতে পারি। আজকের শিশুদের মাঝে এ স্মৃতি কথাগুলো শিশুতোষ কাহিনীরূপে পৌঁছে দিলে, তা তাদের সুন্দর মানসিক বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এ ব্যাপারে বিশেষ মনযোগ দেয়া প্রয়োজন।
এখানে আমরা দেখি, রাসেল সকলের সাথে মিলে মিশে থাকতে পছন্দ করতেন। এমন কি, একজন শিশু হিসেবে তাকে যখন খাইয়ে দেয়া হত, তখনও তিনি একাকী খেতে চাইতেন না। সকলে খেতে বসলে, তাদের সাথে বসিয়ে খাওয়াতে হত তাকে। পরিবারের সাথে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে পাড়ার সব শিশুদের ডেকে নিয়ে বাড়ির আঙিনায় তাদের প্যারেড করাত। ঢাকা থেকেই সবার জন্য প্যারেডের পোশাক কিনিয়ে নিয়ে যেতেন রাসেল। প্যারেড শেষে সবাইকে চকলেট, বিস্কুট খাওয়াতেন। গ্রামের লোকজন তাকে ডেকে আদর করে বড় হয়ে কি হতে চায় জানতে চাইলে, রাসেল বলতেন, তিনি আর্মি অফিসার হতে চান। এতে তার নেতৃত্বের গুণ, সাহসিকতা ও দেশ প্রেমের গুণ প্রকাশ পায়।
দুঃখ-কষ্টকে লুকিয়ে রেখে তা সহ্য করার মত অসাধারণ গুণ ছিল শেখ রাসেলের। বাবার (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু) অনুপস্থিতি কিংবা যে কোন কারণে মনে কষ্ট এলে, নিরবে চোখের জল ফেলতেন। কেউ দেখে ফেললে বা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, চোখে পোকা বা ময়লা কিছু পড়েছে।
১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিশু রাসেলের বয়স ছিল মাত্র ৬/৭ বছর। তখনো তার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আকাশে যখন মিত্রবাহিনীর বিমান উড়ত ও বোমাবর্ষণ করত, তখন বিকট শব্দে সদ্যজাত ভাগিনা জয় (প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা) কেঁপে উঠত, অনেক সময় ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। এটি দেখে রাসেল পকেটে সব সময় তুলা রাখতেন ও বিমানের শব্দ হলে জয়ের কানে তুলা গুজে দিতেন।
দেশ স্বাধীনের পর একজন প্রেসিডেন্টের (বঙ্গবন্ধু) আদরের কনিষ্ঠ সন্তান হয়েও কোন প্রটোকল ছাড়াই নিজে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করতেন। তার পোশাক পরিচ্ছদে ছিল বিশেষ পছন্দ, তাতে তার অনন্য ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত। বোঝা যেত, বড় হলে রাসেল অনন্য মাপের একজন হয়ে উঠবেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে যখন ঘাতকরা মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ করে হত্যাকান্ড আর রক্তের হোলি খেলায় মত্ত, তখন ভয়ার্ত শিশু রাসেল প্রথমে মায়ের কাছে যেতে চাইলেন। ঘাতকরা যখন তাকে মায়ের লাশের কাছে নিয়ে যায়, তখন রাসেল বার বার আকুতি জানাচ্ছিলেন, আমাকে আমার হাসু’পার কাছে নিয়ে চল। আমি হাসু’পার কাছে যাব। শিশু রাসেল বুঝেছিলেন এখন তার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় আজকের শেখ হাসিনা।
ঘাতকরা সে দিন রাসেলকে তার হাসু আপার কাছে নিয়ে যায় নি। তাকে গুলিতে হত্যা করে মায়ের লাশের ওপর ফেলে যায়। এ জঘন্য হত্যাকান্ড সদ্যজাত বাংলাদেশ হারায় তার জনক-জননীকে। নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে বাংলার স্বাধীনতা ও জনগণ। অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, অনেক সংগ্রাম ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ এখন সেই রাসেলের প্রিয় হাসু’পা শেখ হাসিনার হাতে নিরাপদ ও তার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য গতিতে। যত দিন শেখ হাসিনার হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে, তত দিন আমাদের বাংলাদেশের পথ চলা হবে নিরাপদ নির্ভীক। দেশের শিশু-কিশোর-কিশোরীরা একটি নির্মল শৈশব-কৈশোর উত্তীর্ণ করে একটি নির্ভীক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে ওঠবে। আর এ প্রজন্মই হবে আগামীর উন্নত বাংলাদেশ। সকলকে জানাই জাতীয় শেখ রাসেল দিবসের শুভেচ্ছা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা, জয় হোক মানবতার।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান-চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কোষাধ্যক্ষ-চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ