শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শিরোনাম

সংস্কারের অন্তরালে অন্তর্বর্তী সরকারের কালক্ষেপণ?

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

সামছুদ্দীন আজাদ: বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম ধর্ম নিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ, ৩ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিজয়ের শেষ লগ্নে অর্থাৎ ১৪ই ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোসর আজকের জামাতে ইসলামীর তৎকালীন নেতৃবৃন্দ আমাদের বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য শেষ মরণ কামড় দিয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। জামাতী নেতারা সেদিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের সাথে নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে রাতের অন্ধকারে বুদ্ধিজীবীদের বাসায় গিয়ে দরজায় করা নাড়ে এবং বলে স্যারের সাথে কথা আছে, তখন দরজা খোলার সাথে সাথে চোখ বেঁধে রাতের অন্ধকারে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নৃশংসভাবে আমার দেশের সব বুদ্ধিজীবীদের এক রাতেই হত্যা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশ তো স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে দুই দিন পর আমরা যখন বিরোধীতা করে ঠেকাতে পারিনি অন্তত দেশের সব বুদ্ধিজীবী মেধাবী সন্তানদের খুন করে দিয়ে গেলে স্বাধীনতা হবে মেধা শূণ্য, দেশ হয়ে যাবে পঙ্গু, দেশ স্বাধীন হলেও নেতা শূণ্য-মেধা শূণ্য স্বাধীনতা এক দিন বিলীন হয়ে যাবে হয়ত সেই চিন্তা থেকে বুদ্ধিজীবীদের খুন করা হয়।

যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দোসরা আমাদের স্বাধীনতা ঠেকাতে পারেনি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করে ফেলি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের অনেক কষ্ট, ত্যাগ বিসর্জন ছিল, রক্ত ঝরেছে ৩০ লক্ষ দেশ প্রেমিক সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের। এত কষ্ট, এত ত্যাগ, এত বিসর্জন দিয়েও আমরা মনোবল হারাই নি। আমরা আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতার লাল সূর্য্যকে ছিনিয়ে আনতে পেরেছি। পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতন আর কুখ্যাত রাজাকার আলবদরদের নিষ্ঠুর জঘন্য বর্বরতাকে মোকাবেলা করে বিজয়ের সবচেয়ে আনন্দের বিষয়টি ছিল যেটি আমাদের দীর্ঘ নয় মাসের সীমাহীন কষ্টের কথা ভুলিয়ে দেয় পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর দেশ বিরোধী রাজাকার শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছিল ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নিকট অস্ত্র সমর্পণ করে পাকিস্তানের ৯৪ হাজার হাজার সৈনিক। এভাবে দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসনের নামে শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। রাজাকার, আলবদর বাহিনী দেশের বিরোধীতা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিল। পথ-ঘাট দেখিয়ে দিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর-বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প দেখিয়ে দিয়েছিল, বাঙালি নারীদের ধরে এনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল ধর্ষণ আর নির্যাতনের জন্য।

এ ছাড়াও তারা মানুষের ঘর-বাড়ি লুটপাট করেছিল, বাড়ি-ঘরে অগ্নি সংযোগ করেছিল। এত কিছু করার পরও আমাদের স্বাধীনতা ঠেকাতে পারে নি। দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী রাজাকারেরা একটুও অনুতপ্ত, অনুশোচনা করে নি জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা। এরি মধ্যে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতির পিতা এবং যিনি ছিলেন বিবিসি বাংলার জরিপ অনুযায়ী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী তাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু জারজ সন্তান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে নৃশংসভাবে পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ খুন করা হয়। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধ অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসক জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আবির্ভাব হয়। তারা প্রত্যেকে নিজেদের ক্ষমতার সহযোগী হিসাবে কোন যুদ্ধাপরাধী রাজাকার ধর্ষকদের বিচারের আওতায় না এনে নিজেদের দলে ঠাঁই দিয়েছে, সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, খালেদা জিয়া কুখ্যাত রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়ে আনুষ্ঠানিক পেট্রোনাইজ করেছে।

তত দিনে এ দেশে রাজাকাররা ব্যবসায়-বাণিজ্য করে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এসব রাজাকারের বংশধররা অনেকের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কও গড়ে তুলেছে। যার ফলে এত অপরাধের পরও তারা অক্ষত রয়ে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় এসে অনেক দেশি-বিদেশী নিষেধাজ্ঞা, তদবীর ও চাপ উপেক্ষা করে কিছু রাজাকার এবং ৭৫ সালের খুনিদের বিচার করতে পেরেছিলেন। কিছু সংখ্যক অপরাধীর বিচার হলেও সারাদেশে লক্ষ লক্ষ অপরাধী অক্ষত থেকে যায়, তাদের বংশ বিস্তার জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। আজ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর জামাত, বিএনপি, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি, বাম গড়ানোর জন সমর্থনহীন কিছু রাজনৈতিক দল মিলে মিশে একাকার হয়ে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআই মিলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। মুহাম্মদ ইউনুসকে সামনে নিয়ে আসলো ওদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। ইউনুস স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিনিধি হয়ে এ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা নেন। নিজেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী কিছু রাজাকার এবং মার্কিন সাহায্যপুষ্ট কিছু এনজিওর মালিককে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দিয়ে দেশ গঠনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনে নেমেছেন।

দেশকে আওয়ামী লীগ শূন্য করার ঘোষণা দেয়। এরই ফাঁকে বিষয়টিকে জায়েজ করার জন্য বলা শুরু করেছেন বাংলাদেশকে সংস্কার করবেন। কি সংস্কার করবেন? নির্বাচন কমিশন সংস্কার করবেন, সংবিধান সংস্কার করবেন, আইন, শাসন বিচার বিভাগ সংস্কার করবেন। সবকিছু সংস্কার করে দেশে আবার নির্বাচন দেবেন- দেশে আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণআস্থা অর্জন করবেন। ড. ইউনুসের এমন ঘোষণায় সবচেয়ে বেশী খুশি হয়েছেন বিএনপি, তারা দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে অনেকটা ক্ষুধার্ত ও অধৈর্য হয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে তারা বিশাল গণসমাবেশ করে তাদের শক্তির জানান দিয়েছেন। উল্লাস প্রকাশ করেছেন, ফাঁকে ফাঁকে সময়-সুযোগমত আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছেন, লুটপাট করেছেন, ধর্ষণ করেছেন যা তাদের পুরনো অভ্যাস। এরইমধ্যে তারেক রহমান লাগেজ গুছিয়ে নিয়েছেন ঢাকায় অবতরণের জন্য।

ড. ইউনুস তাকে আসতে দেয়নি বলে তিনি আসতে পারেন নি। তারপরও তিনি আশাহত হন নি। প্রতিদিন তিনি লন্ডন থেকে ভার্চুয়াল মিটিং করছেন নেতা কর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। ড. ইউনুস সরকারকে সমর্থন করছেন, সহযোগীতার আশ্বাস দিচ্ছেন, নানা বেদবাক্য শুনাচ্ছেন। এরইমধ্যে ড. ইউনুস ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নির্বাচন দিবেন এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি তার কর্মস্থল গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরে যাবেন। তিনি আরও বলেছেন, দেশে আন্দোলন চলাকালীন তিনি ফ্রান্সে ছিলেন। তাকে সেখান থেকে ডেকে এনে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে নির্বাচনী সময়সীমা ঘোষণা করেছেন, কোন নির্দিষ্ট তারিখ দেননি। বলা হয়েছে, আগামী ২০২৬ সালের জুনের দিকে নির্বাচন দেবেন অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক দেড় বছর পরে। নির্বাচন কমিশনও গঠন করা হয়ে গেছে, নির্বাচন কমিশনেরও কোন সংস্কার করা হয়নি। বিএনপি থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে সংস্কার ছাড়া তারা কোন নির্বাচন মানবে না। এত দীর্ঘ সময়ও তারা অপেক্ষা করতে নারাজ যত দ্রুত সম্ভব তারা নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে চায়।

জোর করে অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে দেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। সারাদেশে একযোগে আওয়ামী লীগ নিধন এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমে জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব হয়নি বলে সংস্কারের কথা বলে মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এরইমধ্যে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রশ্ন হল কি সংস্কার তারা করবেন? সংস্কারের নামে কেবল মানুষ পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের বদলে জামাত-বিএনপির লোকদের বিভিন্ন জায়গায় বসানো ছাড়া আর কোন কিছু করা সম্ভব হবে না। যারা এখন সংস্কারে কাজ করছেন তারা সংস্কারের কনসেপ্ট বুঝে কিনা? তারা এ যাবৎকালে রাষ্ট্রের কোন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছেন কিনা? এমনকি কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন কিনা? সংস্কার এক ধরনের সুরসরি উস্কানী দেয়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যা দিয়ে খুব সহজে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করছেন সরকার। এনজিও ব্যক্তিত্ব দিয়ে একটা দেশের প্রান্তিক মানুষের কিছু উপকার করা যায় তাও সম্ভব যদি দাতারা ঠিকমত পয়সা দেয়। আর ওনারা তো বিদেশী টাকায় বিলাস বহুল জীবন যাপন করেন। সংস্কার এমন একটি শব্দ যার সম্পর্কে ওদের কোন জ্ঞানও নেই, এসব করে কালক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয়।

লেখক: সহ সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ