চট্টগ্রাম: প্রতি বছরের মত এবারো দেশে ৩-১৩ অক্টোবর উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ। এবার সপ্তাহটির প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘পুঁজিাবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে টেকসই অর্থায়ন ও বিনিয়োগকারীদের সহনশীলতা।’ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনের (আইওএসকো ) সাথে যৌথভাবে দিবসটি উদযাপন করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিনিয়োগকারীদের শিক্ষার উন্নতি ও উন্নয়নের জন্য আইওএসকোর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি রয়েছে- এটি একটি বিশ্বব্যাপী প্রচার, যার লক্ষ্য বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা প্রচার করা। সেই ধারবাহিকতায় চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি (সিএসই) বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) একটি ওয়েবিনার করেছে। ওয়েবিনারের শিরোনাম ছিল ‘পুঁজিাবাজারের প্রেক্ষিতে টেকসই অর্থায়ন ও বিনিয়োগকারীদের সহনশীলতা।’
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন বিএসইসির কমিশনার রুমানা ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রাহমান। সভাপতিত্ব করেন সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম। স্বাগত বক্তব্য দেন সিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচারক মো. গোলাম ফারুক। মূল নিবন্ধ উপস্থাপনা করেন সিএসইর চিফ রেগুলেটরি অফিসার মোহাম্মাদ মাহাদি হাসান।
মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও আর্থিক স্বাক্ষরতার উন্নয়নের জন্য বিএসইসির নির্দেশনায় নিয়মিত সেমিনার/কর্মশালা/সম্মেলন আয়োজন করে আসছি। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারীদের জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম রয়েছে, আপনারা ন্যূনতম ব্যয়ে এ সুযোগটি নিতে পারেন। বিনিয়োগকারীদের টেকসই পণ্যের ঝুঁকি ও বিভিন্ন আর্থিক পণ্যকে প্রভাবিত করে- এমন টেকসই-সম্পর্কিত ঝুঁকি বোঝা উচিত। এ বোঝাপড়া বিনিয়োগকারীদেরকে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে ও বিভিন্ন ঝুঁকি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সাহায্য করবে। আমাদের দেশে ইনভেস্টরের অভাব ও বেশিরভাগই ডে ট্রেডার যারা আইটেম বেজড ব্যবসায় করে, সে কারণে কখনো খুব লাভ করে ফের কখনো খুব লস করে। এ জন্য আমাদেরকে ইনভেস্টর তৈরি করতে হবে। বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহের মুল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোকে সফল করতে হবে।’
সাইফুর রাহমান বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের উচিত আপদকালীন ফান্ড রাখা। কারণ, এ ফান্ড যদি না থাকে আর সব ফান্ড পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ফেলে, তাহলে যে কোন জরুরি প্রয়োজন হলে ক্ষতি করে অর্থের যোগান দিতে হয়। কারণ, আমরা চিন্তা-ভাবনা না করে সঞ্চয়ের সব টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ফেলি, কোন কোন ক্ষেত্রে ঋণ নিয়ে, সম্পদ বিক্রি করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করি। যেহেতু পুঁজিবাজার ঝুঁকির জায়গা, এ জন্য আমার বক্তব্য হল- আপনারা সঞ্চয়ের একটা অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করুন।’
‘একটি আইটেমে বিনিয়োগ না করে দেখেশুনে গবেষণা করে বিভিন্ন আইটেমে বিনিয়োগ করুন।’ তবে বিনিয়োগের আগে কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কারা রয়েছেন, কোম্পানিগুলো ভাল লভ্যাংশ দিচ্ছে কিনা, এগুলোর দেখে বিনিয়োগ করার আহবান জানান তিনি।
‘সাসটেনেবল ফাইনান্সের ক্ষেত্রে প্রফিট মাক্সিমাইজেশন নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি লসের বিষয়টাও বিবেচনা করতে হবে।’ এ বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ উপলক্ষে ইন্টারমিডিয়ারিজ প্রতিষ্ঠানগুলো বিএসইসির সাথে ইতিমধ্যে একাত্ত হয়ে কাজ করছে ও ভবিষ্যতেও তিনি এমন সহযোগিতা কামনা করেন সাইফুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘এছাড়া বিআইসিএম, বিএসএএম এবং বিএসইসির ফিনান্সিয়াল লিটারেসি বিভাগও বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করে যাচ্ছে। বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছানো হল- আমাদের সবার দায়িত্ব; যেন তারা তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ বিষগুলোও বিবেচনা করে তাদের ইনভেস্ট করে বিনিয়োগ সুরক্ষা করতে পারে।’
রুমানা ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজারে এখন দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ খুবই কম। সবাই আজকে বিনিয়োগ করে আজকেই গেইন করতে চায়। রাতারাতি মুনাফা তুলে নিতে চায়। এ কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিনিয়োগকারীরা । তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত ঝুঁকি কম নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ করা। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবেন-ই।’
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো প্রথম প্রজন্মের হাতে ভাল চললেও সেকেন্ড জেনারশেনের (দ্বিতীয় প্রজন্ম) হাতে গেলেই কোম্পানিগুলো আর বেঁচে থাকতে পারে না। এগুলো কোন রকম বেঁচে থাকলেও ভাল কিছু করতে পারে না। তার কারণ হচ্ছ, কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এগুলো ঠিক করতে হবে।’
রুমানা ইসলাম বলেন, ‘এসডিজি এবং ইএসজির বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে আমাদের ইনভেস্টর তৈরি করতে হবে। ২০২৪ সালে ইএসজির লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের তৈরি হতে হবে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলো তাদের সাথে কাজ করবে না, যাদের ইএসজি নাই। তাই, আমাদের সাসটেনবল ফাইনান্স ও বিনিয়োগকারীদের সহনশীলতা নিয়ে কাজ করতে হবে। সচেতন ইনভেস্টর তৈরি করতে হবে, অনেক রকম প্রোডাক্ট নিয়ে তাদের জানাতে হবে। এটা নিয়ে সারা বছর কাজ করতে হবে।’
আসিফ ইব্রাহিম বলেন, ‘আইওএসসিও বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং হংকং সিকিউরিটিজ এন্ড ফিউচারস কমিশনের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সম্প্রতি ঠিকই বলেছেন যে, গত দুই বছরে বিশ্বব্যাপী মহামারিকালে, পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়তে দেখা গেছে। ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দরুন উক্ত বিনিয়োগকারীরা এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আর্থিক শিক্ষা ও বিনিয়োগকারী প্রতিরক্ষা, যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে অর্থবাজারে বিনিয়োগকারীদেরই সহনশীলতা ও আস্থা ত্বরান্বিত করতে, জোরালো ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সব স্টেকহোল্ডার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে আইওএসসিওর ষষ্ঠ বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহের কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। আমরা বিনিয়োগকারীদের বিএসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন আর্থিক স্বাক্ষরতা প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে পুঁজিবাজার সম্পর্কে তাদের সচেতনতা বাড়াতে অনুরোধ করি। বিএসইসি আর্থিক স্বাক্ষরতা সম্পর্কিত বিষয়গুলি সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়েছে এবং বিএসইসির স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মসূচির মাধ্যমে এগুলি সারা দেশে পৌঁছে যাবে। টেকসই অর্থায়ন বলতে আর্থিক খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় পরিবেশগত, সামাজিক ও গভর্নেন্স বিবেচনায় নেয়ার প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যা টেকসই অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগকারীদেরকে আরো দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগের দিকে পরিচালিত করে। জাতিসংঘের সাসটেইনএবল স্টক এক্সচেঞ্জের (এসএসই) উদ্যোগ ২০০৯ সালে প্রবর্তিত জাতিসংঘের একটি অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচি। এটি আনটাঙ্কড, জাতিসংঘের গ্লোবাল কম্প্যাক্ট, জাতিসংঘের পরিবেশ ও দায়িত্বশীল বিনিয়োগের নীতি দ্বারা পরিচালিত। এটি এসডিজি ইস্যুতে ঐক্যমত্য ও সক্ষমতা গড়ে তুলতে স্টক এক্সচেঞ্জ, পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারী, তালিকাভুক্ত কোম্পানি, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকদের একত্র করে।’