এনএম ফখরুদ্দীন: মেধা ও শিক্ষা দুইটি ভিন্ন বিষয়। পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা শিক্ষা যাচাই করি, মেধা নয়। বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ালেখার মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করা গেলেও মেধার বিকাশ হয় না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে, স্যূট টাই পড়ে ইংরেজিতে একটু অনর্গল কথা বলতে পারলে তাকে আমরা মেধাবী আর স্মার্ট বলি। এটি ভুল। প্রকৃত মেধা ও প্রতিভার বিশ্লেষণ এমন নয়। শিক্ষা আর প্রকৃত শিক্ষা এক নয়। আমরা বেশীরভাগ মানুষ শুধু সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত, মন মানসিকতা আর আচার-আচরণের দিক দিয়ে নয়। মানুষতো মেধা কিংবা প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবে তার কাজে, কথা আর পোশাকে নয়।
আরেকটি সমস্যা হল- এ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে মেধা ও প্রতিভার যেমন মিল নাই, তেমনি পেশার সাথেও শিক্ষার অনেকাংশে সমন্বয় দেখি না। এ বিষয়টি অভিজ্ঞতা থেকে শেয়ার করছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে অনার্স ও থিসিসসহ মাস্টার্স পাশ করে আমার বন্ধুদের কেউ ব্যাংকের ম্যানেজার হল, কেউ বিসিএসের পাঠ চুকিয়ে পুলিশের এএসপিতে যোগ দিল, কেউ ম্যাজিষ্ট্রেট হল, কেউ পররাষ্ট্র ক্যাডারে গেল। এ পেশাগুলোতে তাদের অর্জিত সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার গবেষণালব্দ বিষষের (রসায়ন) কিছুই প্রয়োগ হয় না। বাংলাদেশে এমন ভুরিভুরি ঈর্ষণীয় চ্যালেঞ্জিং সাবজেক্ট আছে; যেগুলোতে অর্জিত নলেজের সাথে চাকুরির কোন সমন্বয় নাই। অথচ দেশের বাস্তবতার নিরিখে এ পেশাগুলোতে অনুপ্রবেশ অনেকটা স্বপ্নে লালিত কাঙ্খিত চাকুরীর সদৃশ। শিক্ষা জীবনে অর্জিত জ্ঞান এখানে ব্যবহার করার সুযোগ নাই। পেশাগত দক্ষতার জন্য তাদেরকে নতুন করে চাকুরী সংশ্লিষ্ট জ্ঞান আয়ত্ত করতে হয়। পেশাগত জীবনে প্রয়োগ ক্ষেত্র না থাকায় শিক্ষা জীবনের অর্জিত জ্ঞান ও মেধার অপচয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার পেশার সাথে অর্জিত জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে আমাদের মত যারা শিক্ষকতা পেশাকে বাছাই করে নেন তাদের ক্ষেত্রে মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। কারণ, বাংলাদেশের শিক্ষকরা পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশের শিক্ষক অপেক্ষা বহু বেশি অবহেলিত। এটি মেধার অবমূল্যায়ন নয় কি? অন্যান্য দেশগুলোতে শিক্ষকতায় যারা আসেন তাদের জীবন মান অনেক উন্নত। এসব শিক্ষক নিজ নিজ দেশে বহু বেশি সম্মানিত। সেসব দেশে শিক্ষকতার সম্মানি অন্যান্য পেশা থেকে বেশি। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন দেখে বাংলাদেশে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না।
এ দিকে, শিক্ষার সাথে মেধা ও প্রভিভার বিকাশের নিমিত্তে যে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, সেখানেও দেখছি সেই আগের মত মুখস্ত করতে হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের। বরং, আগে যেমন শুধুমাত্র অনুশীলনীর প্রশ্নগুলো পড়তে হত, এখন সেখানে গাইড বইয়েল আরও একশোটা প্রশ্ন মুখস্ত করতে হয়। এখনকার স্কুলের বাচ্চাগুলোকে দেখলে আসলেই খুব মায়া লাগে। পড়াশোনা আর ভারী ভারী বইয়ের চাপে ওদের শৈশব শেষ।
সৃজনশীলতার নামে আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। এ শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষাও নয়, আবার সৃজননশীলও নয়। আর কোচিং বাণিজ্য নিয়ে কী আর লিখব। শিক্ষাকে ক্লাসরুমে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন, প্রয়োজনীয় কিন্তু ছোট আকারের সিলেবাস তৈরি করা, চাকরি ও রেজাল্ট নির্ভর মেন্টালিটি পরিহার করে জ্ঞান নির্ভর ও গবেষণাধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু করা এবং অভিভাবকদের এমন সচেতন হওয়া, যাতে বাচ্চাদের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন বাদ দিয়ে কত ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ছে ও কতজন শিক্ষক/কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে তা মুখ্য না হয়।
প্রাইমারি লেভেলের একটি বাচ্চাকে ১৪-১৫টি বই নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। তার সাথে খাতা-কলমসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র তো আছেই। এ জন্য অনেক সময় বইয়ের ব্যাগ বহন করার জন্য বাবা-মা অথবা অন্য কেউ বাচ্চাটির সাথে যেতে হয়। অথচ শিশু শিক্ষা হওয়ার কথা ছিল আনন্দের। সে হেসে খেলে পড়াশুনা করবে, যাতে তার মনে শিক্ষাভীতি না আসে।
জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত করলে বিষয়টি পরিস্কার হয়। তারা শিক্ষা ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলে। তাদের শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর মেধা ও সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন। তারা শিক্ষার মাধ্যমে পাঠ্য বই থেকে জ্ঞান অর্জন করে অন্যান্য উৎস কিংবা অপাঠ্য বই থেকে শেখার পথ উম্মুক্ত করে। এতে তাদের শিশুদের মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে শিশুরা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় না, তার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো স্কুলে থাকে। তার পড়াশুনার পাঠ স্কুলেই শুরু, স্কুলেই শেষ। নেই হোমওয়ার্কের বাড়তি ঝামেলা। এ জন্য মনের আনন্দে শিশুরা স্কুলে যায়। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু পাঠ্য বই তোতাপাখির মত শিখিয়ে এ+ সনদ অর্জন করাকে যথেষ্ট মনে করা হয়। এ শিক্ষা পদ্ধতি বৃটিশদের শেখানো।
লেখক: অধ্যক্ষ, বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।