চট্টগ্রাম: ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অন্যতম ওড়িশী নৃত্যশিল্পী ও কল্পদীপ নৃত্যপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ড. পম্পি পাল সাত দিনের ওড়িশি নৃত্যের কর্মশালা করাতে চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। দেশের অন্যতম ওড়িশি নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওড়িশী অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার চট্টগ্রামের পরিচালক প্রমা অবন্তীর আমন্ত্রণে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের ১২০ জন শিক্ষার্থীকে নৃত্যের কর্মশালা করাচ্ছেন। পম্পি পাল বালিতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনের (আইসিসিআর) হয়ে সেখানকার ভারতীয় কনস্যুলুটের আওতাধীন স্বামী বিবেকানন্দ কালচারাল সেন্টারে ২০১৯-২০২২’-এর গোড়া পর্যন্ত নৃত্য শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন। সেখানে বালিনিজ নাচের সাথে ওডিশি নাচের আঙ্গিকের বহু সাদৃশ্য তার নজরে আসে। সংস্পর্শে আসেন ইন্দোনেশিয়ার প্রখ্যাত নৃত্য গবেষক পদ্মশ্রী ই বায়ান দিবিয়ার। ঐতিহ্যশালী ওড়িশী নৃত্য যে অনেকটাই বালিনিজের দ্বারা প্রভাবিত- এমনটাই মনে করেন ওই নৃত্য শিল্পী। আধুনিক নাচের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা পম্পির জলপাইগুড়িতে কল্পদীপ নামে নাচ শেখানোর একটি স্কুলও রয়েছে। সেখানেই প্রায় ৬০ জন ছেলেমেয়েকে তিনি তালিম দেন ওডিশির ওপর। একটি দল তৈরি করেছেন যাদের নিয়ে সুযোগ এলেই দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ান এখানকার কচিকাঁচাদের প্রতিভা প্রদর্শনে। ২০২২ সালের নভেম্বরে বালিতে আয়োজিত জি-২০ শীর্ষ সন্মেলনে যোগ দিতে যেই বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে গিয়েছিলেন, সেই সময় ইন্দোনেশিয়ার ভারতীয় বংশদ্ভুতদের একটি অনুষ্ঠানের নৃত্য প্রদর্শনীতে কোরিওগ্রাফির জন্য তাকেই বেছে নেয় ভারতীয় কনস্যুলেট।
চট্টগ্রামে আসা উপলক্ষে পম্পি পালের সাথে আলাপচারিতা-
প্রশ্ন: বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে? বাংলাদেশের আতিথিয়তা সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?
পম্পি পাল: খুব ভাল লাগছে। এর আগেও এক বার ২০০৮ সালে আসা হয়েছিল। বাংলাদেশের আতিথিয়তা সম্পর্কে আমি সব সময় বলি, আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী বাংলাদেশের আতিথিয়তার কাছে কিছুই নই।
প্রশ্ন: নৃত্য নিয়ে বাংলাদেশের নতুন শিল্পীদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু যদি বলেন।
পম্পি পাল: আমার খুব ভাল লাগে, বেশ কিছু বছর আমি রবীন্দ্রভারতীতে চাকরি করেছি। সেই সময় বেশ কিছু বাংলাদেশী যারা নৃত্যশিক্ষা নিতে রবীন্দ্রভারতীতে পড়তে গিয়েছিলেন, তাদের পাওয়া হয়েছে ও একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, তাদের মধ্যে শেখার অদম্য আগ্রহ ছিল, খুব ভাল করে শিখতে চেয়েছে। এখনো অনেকের সাথে যোগাযোগ আছে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় আমার দেশের নাচকে তারা এত সুন্দর করে আপন করে নিয়েছে ও বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও তাঁরা ভীষণ ভালে কাজ করবে শুধু বাংলাদেশে কিংবা ভারতে নয় বিশ্বের যে কোন জায়গায় তারা তাদের কলাকে পরিবেশন করার সুযোগ পাবে ও খুব ভালভাবে আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিকে ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
প্রশ্ন: কীভাবে নৃত্যের জগতে আসা? ছোটবেলার অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করতেন।
পম্পি পাল: নৃত্য জগতে আসা খুব অদ্ভুতভাবে। আমরা যারা বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গে রয়েছি, ছোট থেকেই একটা অভ্যাস রয়েছে যে, আমরা কিছু নাচ শিখে থাকি, সেটা বাড়ির কারো কাছ থেকে বা কোন নাচের স্কুল থেকে শিখে থাকি। বহু সময় দেখে-দেখে করতে থাকি। কারণ, এটা আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে। ঠিক সেইভাবে আমি আমার ছোট মাসীর কাছে দুটো নাচ শিখেছিলাম, বাবা মনে করেছিলেন যে, আমার নাচের প্রতি আগ্রহ রয়েছে, নাচ শেখানো যেতে পারে আমাকে। আমি তখন আমার যিনি গুরু যার কাছে কথক শিখেছি। আমি ১৩ বছর কথক শিখেছি গুরু রুনু ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। উনার স্কুল গীতিনৃত্যমে বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন এবং সাড়ে চার বছর বয়সে নাচের জগতে আসা এখন নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠেছি। নাচ নিয়েই জীবন চলছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ওড়িশী নৃত্যশিল্পী ও দেশের অন্যতম ওড়িশী নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওড়িশী অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার চট্টগ্রাম (ওটিডিএমসি) সম্পর্কে কিছু বলুন-
পম্পি পাল: সবার আগে প্রমা অবন্তী দিদির কথা বলব। আমি ওড়িশী নৃত্যগুরু গুরু পৌষালী মুখার্জির ছাত্রী ও দিদিও উনার ছাত্রী। সে জায়গা থেকে দিদি আমার গুরু বোন। এখন যে আমি চট্টগ্রামে এসেছি, আমার গুরুর আদেশেই আসা ও এখানে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নাচ শেখানো।৩-৪ দিন ধরে ওড়িশী নৃত্যের কর্মশালা চলছে এবং যেটা দেখে সেটা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শেখার ভীষণ আগ্রহ। এত সুন্দর করে অল্প সময়ের মধ্যে কঠিন আইটেম শেখানো হচ্ছে, তারা খুব সহজে তুলে নিতে পারছে। এতে এটাই প্রমাণ হয় প্রমা দি ও প্রমা দির শিষ্যারা খুব যত্ন নিয়ে মেয়েদের তৈরি করছেন। নাচ শেখাটা তো শুধু শারীরিক অঙ্গভঙ্গি নয়, সেটার সাথে সংস্কৃতিটাকে শেখা, জানা, বোঝা ও সম্পূর্ণভাবে তাতে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া, মেয়েদের মধ্যে সেই নিমজ্জিত হওয়ার ব্যাপারটা একদম স্পষ্টভাবে দেখলাম। প্রমা দি বরাবরই খুব ভাল কাজ করে। ভারতের বিভিন্ন ওড়িশী নৃত্য উৎসবেও চট্টগ্রামের এ প্রতিষ্ঠানটি বেশ সুনাম অর্জন করেছে, তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে। ওড়িশী উৎসবে অনুষ্ঠান করতে পারাটাও আমাদের জন্য ভাগ্যের বিষয়, সেই রকম জায়গায় এ প্রতিষ্ঠানের মেয়েরা অনুষ্ঠান করে সত্যি তারা মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা। তারা ওড়িশী নৃত্যটাকে বিশ্বদরবারে আরো সমাদৃত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ওড়িশী নৃত্যের ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বলুন-
-আমি ভীষণ আশাবাদী। কারণ, যেটুকু দেখলাম, আমার গুরু পৌষালী মুখার্জী উনি এর আগেও এসছেন এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। উনি আমাকে অবগত করেছেন এখানে ছেলে-মেয়েদের খুব যত্ন করে শেখানো হয়, তারা ভীষণ আগ্রহী ও আমি তার প্রমাণ পেলাম এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলছি, অদূর ভবিষ্যতে এ প্রতিষ্ঠানের মেয়েরা বিশ্বদরবারে নিজেদের নামকে আরো উজ্জ্বল করবে।
প্রশ্ন: কর্মশালায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও আগ্রহ নিয়ে আপনার মতামত কী?
পম্পি পাল: প্রায় ১০০’রও অধিক শিক্ষার্থী কর্মশালায় স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়েছে। যে কোন কর্মশালায় এত জন শিক্ষার্থী পাওয়া নি:সন্দেহে বড় ব্যাপার। কারণ, যখন আমরা এমন কোন আয়োজন করি, শিক্ষার্থীদের আমরা অবগত করি, কিন্তু তারা তাতে অংশগ্রহণ করবে কিনা সেটা তাদের নিজস্ব মতামত। এখনকার সময়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাসহ নানা শৈল্পিক কাজে ব্যস্ত থাকে, খেলাধুলা, স্কুল, পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার মাঝে তারা এসে কর্মশালায় ২-৩ ঘন্টা সময় বের করছে, সেটা বহু বড় ব্যাপার। কারণ, এটা তাদের নিয়মিত ক্লাসের অংশ নয়। সাধুবাদ জানাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ছুটির সময়েও তারা কিছু শেখার জন্য উদগ্রীব। নাচ করে শিক্ষার্থীরা আনন্দ পাচ্ছে।
প্রশ্ন: বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে ৪০০’রও অধিক শিক্ষার্থী এ প্রতিষ্ঠানে নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আপনার মতামত কী?
পম্পি পাল: ভীষণ বড় ব্যাপার। আমরা যারা নাচ শেখাই, ভাবি যে, একটু বেশি শিক্ষার্থী হলে ভাল হয়। কোন শিল্পকলাকে এগিয়ে নিতে সকলের সহযোগিতা ভীষণ দরকার। এইযে এত মেয়েরা শিখছে, এটা এক ধরনের বড় সহযোগিতা। প্রতিটা শিক্ষার্থীই একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথে শারীরিক ও মানসিকভাবে আধ্যাত্মিক একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।এতগুলো ছেলেমেয়ে ওড়িশী শিখছে তা নয়, রবীন্দ্র নৃত্যও শিখছে, নি:সন্দেহে আনন্দের।