রবিবার, ১৯ মে ২০২৪

শিরোনাম

সায়মন রাশেদের ধারাবাহিক উপন্যাস: লাল নীল হলুদ ।। পর্ব তিন

শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ৯, ২০২৪

প্রিন্ট করুন
সায়মন রাশেদ

কথাটা শুনে আমি একটা বড় ধাক্কা খেলাম। নির্বাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকলাম। ওর মুখে এখনো হাসিটা লেগে আছে। আমি এবার ফিরে তাকালাম ওই মহিলাটির দিকে। তিনি আমাদের থেকে খানিকটা দূরে দাড়িয়ে আছেন। তার পিঠ আমাদের দিকে থাকায়, তার চেহারা দেখতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর যখন তিনি পিছনে ফিরলেন, তখন আমি তাকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। জ্যোৎস্নার আলোতে আমি যা দেখলাম, তা বিশ্বাস করার মত না। আমি যার দিকে তাকিয়ে আছি, সে আমার স্ত্রী। যে কিনা তখন থেকে সাত বছর আগেই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল।’

এতটুকু বলার পর লোকটা থেমে গেল। রাজুর মুখে কোন কথা নেই। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে লোকটার দিকে। কিছুক্ষণ পর লোকটা আবার বলতে শুরু করল।
‘আমার স্ত্রীর নাম সুমিতা। সুমিতার সাথে আমার বিয়ে হয় তখন থেকে প্রায় নয় বছর আগে। আমরা একে অপরকে ভালবাসতাম। কিন্তু আমাদের পরিবার তা মেনে নেয় নি। তাই, আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। বিয়ের দুই বছর পর আমাদের কোল আলো করে আসে আমাদের মেয়ে। ভুল হয়েছে আমাদের নয়, শুধু আমার। আমার স্ত্রী আমার মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। জন্মের পর তাই প্রথম সে তার বাবার কোলেই আসে। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে ডাক্তার ওকে আমার কোলে দেয়ার পরপরই ও কান্না থামিয়ে দেয়। আমার আর সুমিতার পরিবার এসেছিল আমাদের সাথে দেখা করতে। দুই পরিবারই চায় আমার মেয়েটার দায়িত্ব নিতে। কিন্তু, আমি আমার মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেই। সেই দিনই সুমিতাকে তার পরিবারের লোকেরা কবর দিতে নিয়ে যায়। আমি তাদের সাথে যেতে পারি নি। কারণ, আমার মেয়েটা আমার কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে যেতে চায় না। অন্য কেউ ওকে কোলে নিলে ও শুধু কাঁদে। শত দুঃখের মধ্যেও তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে আমার মেয়েটার সাথেই থাকি। এরপর বেশ কিছু দিন আমি আমার পরিবারের সাথে বেশ কিছু দিন ছিলাম। আমার পরিবার আমাকে আবার বিয়ে করে সংসারী হতে বলে। আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম আমার জন্য না হোক ওর কথা ভেবে না হয় করব আবার বিয়ে। ওরও তো একজন মা দরকার। কিন্তু, বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলাম, ওর নতুন মা কি ওকে ওর আসল মায়ের মতই ভালবাসবে? এ কথা ভেবে আমি আর বিয়ে করি নি। কিছু দিন পর আমি আবার আমার পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যাই। আমার মেয়েকে একাই আমি বড় করতে থাকি। এরপর থেকে ওর কাছে আমিই ওর মা, আমিই ওর বাবা। ওর যে মা নেই, ও কখনো জানতে চাইতো না ওর মার কথা। এ নিয়ে ওর কোন দুঃখও ছিল না। কেউ ওর কাছে ওর মায়ের কথা জানতে চাইলে ও বলত, আমিই ওর বাবা, আমিই ওর মা। কথাটা প্রতিবারই আমার চোখে পানি এনে দিত। এভাবেই চলছিল আমাদের জীবন। কিন্তু, একটা রাতে পাল্টে গেল সবকিছু।’

লোকটা একটু থেমে আবার বলতে লাগল।
‘সেই জ্যোৎস্না রাতে সুমিতাকে দেখে আমি একসঙ্গে ভয় পাই, দুঃখ পাই ও মর্মাহত হই। বাতাস বইছিল। বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছিল। জ্যোৎস্নার আলোতে আমি আমার স্ত্রীকে দেখে কষ্টে ভেঙ্গে পড়ি। আমার মুখে কোন কথা নেই, শুধু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আমার স্ত্রী অত্যন্ত সুন্দর ছিল। জ্যোৎস্নার আলোতে তাকে দেখতে অপরূপ লাগছিল। তার পড়নের আমার দেয়া হলুদ শাড়িটা বাতাসে উড়ছিল। আমি সুমিতাকে জিজ্ঞাস করলাম,
‘কেন এসেছ সুমিতা?’
সুমিতা একটা হাসি দিল। হাসি দিয়ে বলল,
‘আমার মেয়েকে নিতে এসেছি।’
আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছিল না। আমি হটাৎই আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলি,
‘আমার মেয়েকে আমি নিতে দেব না। ও কোথাও যাবে না তোমার সাথে। তাই না মা? বল।’
ও বলল,
‘মার কাছে যাব।’
আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। ও আবার বলে,
‘আমি মায়ের কাছে যাব বাবা।’
আমি বললাম,
‘তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না মা।’

আমি ওকে কোলে নিয়ে পিছে ঘুরলাম। দেখি, সুমিতা আমার দিকে একটা হাসি দিয়ে সামনের দিকে মুখ ফিরিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এক সময় ও দূরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমার মেয়ের মুখ আমার কাধের উপর ছিল। ও বলল,
‘বাবা আমি মার কাছে গেলাম। ভাল থেক বাবা।’

আমি ওর মুখ আমার সামনে আনি। দেখি, ও নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। আমি তখনই ওকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বলে, ও মারা গেছে। কে জানতো ওই রাতের বাবা ডাকটাই আমার জীবনের শেষ শোনা বাবা ডাক হবে। প্রকৃতি থেকে একটা ফুল নিয়েছিলাম বলে, প্রকৃতি আমার জীবন থেকে একটা ফুল নিয়ে গেল। ওর মৃত্যুর পরপর কিছু দিনের জন্য আমি কথা বলা বন্ধ করে দেই। শেষ কথা বলেছিলাম, ওদের কাছে চলে যাওয়ার দিন।’

রাজু স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে।
‘ওদের কাছে চলে গিয়েছিলেন মানে?’
লোকটা এবার রাজুর চোখের দিকে তাকায়। এবার রাজু লোকটাকে চিনতে পারে। রাজু কাপাকাপা গলায় তাকে জিজ্ঞাস করে,
‘আপনার মেয়ের নাম কি?’
লোকটা বলল,
‘শিউলি।’

চলবে…