শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

সায়মন রাশেদের ধারাবাহিক উপন্যাস: লাল নীল হলুদ ।। পর্ব চার

সোমবার, ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

কথাটা শোনার পরপরই কে যেন রাজুর বাম হাত ধরে টানল। রাজু পাশ ফিরে দেখে তার বাম পাশে বসে আছে একটা ছোট মেয়ে। মেয়েটা রাজুর হাত ধরে আছে। মেয়েটা লাল জামা আর ফ্রক পড়া। মেয়েটাকে দেখতেও অনেক সুন্দর। মেয়েটার গায়ের রং অসম্ভব ফর্সা। সে রাজুর দিকে তাকিয়ে আছে।
রাজু জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার নাম কি?’
মেয়েটা বলল,
‘শিউলি।’
রাজু তাকিয়ে আছে শিউলির দিকে। কিছুক্ষণ পর কে যেন ডাকল,
‘শিউলি…’
রাজু সামনে তাকাল; তার সামনে হাত তিনেক দূরে দাড়িয়ে আছে হলুদ শাড়ি পড়া একজন অত্যন্ত সুন্দর মহিলা। রাজুর বুঝতে দেড়ি হল না যে, উনিই শিউলির মা সুমিতা। শিউলি এক ছুটে তার মায়ের কাছে চলে গেল। এরপর লোকটাও উঠে দাঁড়াল। সেও হেঁটে হেঁটে গিয়ে তার স্ত্রী আর মেয়ের সাথে মিলিত হল।

তারা চলে যাচ্ছে। তারা সামনের দিকে হেঁটে চলেছে। তাদের মাথার উপর চাঁদ। চাঁদের জ্যোৎস্নায় তাদের লাল, নীল, হলুদ রংগুলো ফুটে উঠেছে। রাজু পিছন থেকে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা তিনজনই পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে রাজুর দিকে তাকাল। তাদের মুখে একটুকরো হাসি লেগে রয়েছে। তারা বলে উঠল,
‘ভালো থেকো।’

এরপর রাজুর জ্ঞান ফেরে ভোরের দিকে। রাজু উঠে দেখে সে মাঠে শুয়ে আছে। সে মাটিতে উঠে বসে। কিছুক্ষণ কাল রাতের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে। তারপর সে উঠে দাঁড়ায়।

রাজুর মনে পড়ে লোকটার কথা। হ্যাঁ, রাজু তাকে চেনে। রাজু যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে, তখন তাদের পাসের বাসায় নতুন এক ভাড়াটে পরিবার আসে। পরিবারে মাত্র একটা লোক আর তার মেয়ে। যে দিন আসে সেদিনই তাদের সাথে রাজুর পরিবারের ভাব হয়ে যায়। কারণ, বাবা ও মেয়ে দুইজনেই মিশুক প্রকৃতির। রাজুর সাথেও সে দিনই বন্ধুত্ব হয় শিউলির। প্রথম দিনই রাজুর সাথে শিউলির ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়। শিউলির বাবা ফারুক আঙ্কেলও খুব ভাল পায় রাজুকে। রাজুকে আদর করে। কাছে ডেকে কথা বলে। মাঝেমাঝে তাদের সাথে খেলেও। বহু দিন পর খেলার সাথি পেয়ে অনেক খুশি ছিল রাজু। এক বার রাজু আর শিউলি দৌড় প্রতিযোগিতা লাগে। যে যত দূরে যেতে পারে। প্রতিযোগিতায় কেউই হারতে চায়নি। তাই তারা দৌড়াতে দৌড়াতে বাসার থেকে বহু দূরে চলে আসে। এরপর যখন তাদের খেয়াল হয়, তখন তারা কোথায় এসেছে, তারা বুঝতে পারে না। এদিক ওদিক খানিক্ষণ ঘোরার পর তারা বুঝতে পারে, যে, তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে। রাজুতো প্রায় কাঁদতেই বসেছিল, এমন সময় তাদের চোখে পড়ে রাস্তার একপাশে পড়ে আছে একটা ছোট চারা গাছ। সেটার মূল একটা প্লাস্টিকের আধকাটা বোতলের ভেতরে। বোতলটা ফেটে গেছে। ভেতরের মাটি অনেকটাই বেড়িয়ে এসেছে। রাজু বলল,
‘এভাবে চারা গাছটাকে কে ফেলে রেখেছে?’
শিউলি বলল.
‘এটা তো জবা ফুলের চারা। আমি বইতে দেখেছি। এটাকে তাড়াতাড়ি মাটিতে রোপণ করতে হবে। তা না হলে চারাটা মারা যাবে।’

রাজু আর শিউলি ধরাধরি করে গাছটাকে একটা মাঠে নিয়ে আসে। মাঠের এক কোণে গিয়ে চারা গাছটা মাটিতে রোপণ করে। চারা গাছ লাগাতে গিয়ে দুইজনের গায়ে মাটি লেগে একাকার অবস্থা। এরপর তারা ভাবল গাছটাকে পানি দিতে হবে। এখন পানি পাবে কোথায়? তারা দেখল মাঠের একপাশে এক লোক ঝাড়ু দিয়ে মাঠের পাতা ও অন্যান্য ময়লা পরিষ্কার করছেন। তাকে গিয়ে তারা জিজ্ঞাস করল,
‘আঙ্কেল এখানে পানি কোথায় পাব বলতে পারেন?’
হটাৎ করে জিজ্ঞেস করায় লোকটা প্রথমে বুঝতে পারে নি। তার খেয়াল হওয়ার পর সে বলল,
‘কিছু বললা বাবারা?’
এবার শিউলি আবারও বলল,
‘আঙ্কেল এখানে পানি কোথায় পাব বলতে পারেন?’
লোকটা বলল,
‘পানি দিয়া কি করবা?’
রাজু বলল,
‘আমরা একটা গাছ লাগিয়েছি আঙ্কেল। গাছে পানি দেব।’
উনি বলল,
‘কোন গাছ?’
রাজু আর শিউলি মাঠের কোণার দিকে দেখিয়ে বলল,
‘ঐ জবা ফুলের চারাটা।’
বাচ্চাদের ছেলেমানুষি। লোকটা ভাবল।
এরপর বলল,
‘আচ্ছা তোমরা দাঁড়াও, আমি পানি নিয়া আসি।’

এ কথা বলে উনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর উনি এক মগ পানি নিয়ে আসলেন। তারপর রাজু আর শিউলির সামনে গাছে পানি ঢাললেন। তা দেখে রাজু আর শিউলি হাততালি দিল। এরপর উনি দুইজনকে বলল,
‘যাও বাবারা, এখন বাড়ি ফিরা যাও। দুপুর হইয়া গেছে।’
এ কথা শুনে তারা চুপ করে গেল।
রাজু আরেকটু হলেই কান্না করে দিত। শিউলি বলল,
‘আমরা হারিয়ে গেছি আঙ্কেল।’
উনি বিস্মিত হয়ে বললেন,
‘হায়, হায় কি বল! আগে বলবা না। তোমাগো বাসা কই?’

শিউলি আর রাজু তাদের বাসার এড্রেস বলল। উনি তাদের ঠিকানা মত বাসায় পৌঁছে দিল। শিউলিকে পেয়ে তার বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি খুশিতে কেঁদেই দিলেন। অন্য দিকে, রাজুর পরিবার তাকে পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেও, তাকে বকা ঝকা করল। বিদায় দেয়ার সময় ওনাকে ফারুক আঙ্কেল বলল,
‘আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব, বুঝতে পারছি না।’

উনি হাসলেন, কিছু বললেন না। শিউলি আর রাজুর বাবা ওনাকে ভাত খেয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু, উনি বললেন উনি আজ না অন্য এক দিন খাবেন। যাওয়ার সময় ওনাকে শিউলি বলল,
‘আঙ্কেল আমার একটা কথা রাখবেন?’
উনি শিউলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘কি কথা মা?’
শিউলি তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘গাছটাতে প্রতিদিন পানি দিতে পারবেন?’
উনি হেসে বললেন,
‘পারব মা। এখন থেকে ঐ গাছের দেখাশুনার দায়িত্ব আমার।’

চলবে…….