শিউলির চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে যায়। তার মুখে জ্যোৎস্নার আলোর মত সুন্দর একটা হাসি ফুটে ওঠে। এরপর তিনি চলে যান। এরপর এভাবেই রাজু আর শিউলির বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল তাদের সময়। কিন্তু, হটাৎ এক দিন রাজু দেখল তার মা কাঁদছেন এবং ফারুক আঙ্কেলকে ঘিরে রয়েছে অনেক লোক। তার পাশে বসে আছেন রাজুর বাবা। তিনি আঙ্কেলকে কি নিয়ে যেন সান্তনা দিচ্ছেন। রাজু তার মাকে জিজ্ঞাস করল,
‘মা, কি হয়েছে?’
তার মা কোন জবাব দেয় না। শুধু কাঁদে। বাবাকে জিজ্ঞাস করলে বাবাও কোন জবাব দেয় না।
ফারুক আঙ্কেলের কাছে শিউলি কোথায় রাজু জানতে চাইলে আঙ্কেল কোন কথা বলে না। রাজুর বাবা তাকে ধমক দিয়ে ঘরের ভিতরে পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনার তিন থেকে চার দিন পর এক দিন রাতে ফারুক আঙ্কেলের সাথে রাজুর দেখা হয়। আঙ্কেল তাকে দেখেই জিজ্ঞাস করে,
‘ভাল আছ রাজু?’
রাজু মাথা নাড়ে। রাজু জিজ্ঞাস করে,
‘শিউলি কোথায় আঙ্কেল?’
উনি হেসে জবাব দেয়,
‘শিউলি একটা মাঠে বসে জ্যোৎস্না দেখছে।’
রাজু বলে,
‘ও আর আসবে না?’
উনি বলল,
‘ও আসতে চায় না, আমিই যাই ওর কাছে।’
রাজু বলল,
‘কেন আঙ্কেল?’
উনি কোন উত্তর দিলেন না।
রাজু আবার জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি এখন ওর কাছে যাচ্ছেন আঙ্কেল?’
উনি বললেন,
‘হ্যাঁ।’
রাজু বলল,
‘আমিও যাব আঙ্কেল। আমিও শিউলির সাথে দেখা করব।’
উনি হেসে বললেন,
‘তোমার সাথে আরেক দিন দেখা করাব ওর।’
রাজু বলল,
‘প্রমিস আঙ্কেল?’
উনি বললেন,
‘প্রমিস।’
এরপর রাজু ওনাকে জিজ্ঞাস করে,
‘আচ্ছা আঙ্কেল শিউলি জ্যোৎস্না দেখতে মাঠে গেল কেন?’
উনি বললেন,
‘জ্যোৎস্না দেখতে হয় খোলা মাঠে বসে। জ্যোৎস্নার পুরো সৌন্দর্য দেখতে হলে খোলা মাঠে গিয়েই জ্যোৎস্না দেখতে হয়।’
কথাটা বলেই উনি চলে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে বলল,
‘আমি যাই রাজু, শিউলি ডাকছে আমায়। এক দিন দেখা হবে তোমার সাথে আমাদের। ভাল থেকো।’
সে দিন রাতেই রাজু ফারুক আঙ্কেলকে শেষ বার দেখেছিল। এরপর ওনাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। থানা-পুলিশ হওয়ার পরও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। এর কিছু দিন পর রাজুরা বাসাটা ছেড়ে দেয়। যাওয়ার সময় রাজু খুব কান্না করে। এরপর কেটে গেছে নয়টি বছর। নয় বছর পর তাদের সাথে দেখা হল রাজুর। তবে কি কাল রাতে শিউলি, ফারুক আঙ্কেল আর শিউলির মা সুমিতা আন্টির সাথে তার সত্যিই দেখা হয়েছিল? নাকি পুরাটাই তার কল্পনা? সেটা কি শুধুই স্বপ্ন ছিল? স্বপ্ন এতটা বাস্তব হয়?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে জবা ফুলের গাছটার কাছে এসে পড়েছে রাজু। এসে দেখে, সেখানে গাছে পানি দিচ্ছে এক বৃদ্ধ লোক। তিনি এক হাতে মগ দিয়ে গাছে পানি ঢালছেন, অন্য হাতে একটা ঝাড়ু ধরে আছেন। রাজু তাকে জিজ্ঞাস করল,
‘ভাল আছেন?’
লোকটা বিস্মিত হয়ে পিছনে ঘুরে রাজুর দিকে তাকাল। তাকিয়ে বলল,
‘জি ভাল আছি। আপনি কেডা?’
‘আমাকে আপনি চিনবেন না।’
‘চেনাচেনা লাগতেছে।’
‘আপনি কখন এসেছিলেন এখানে?’
‘এইতো একটু আগেই আইলাম।’
‘আপনি কি প্রতিদিন সকালে এসেই আগে গাছে পানি দেন?’
‘হ বাবা।’
‘প্রত্যেক দিন একই কাজ করতে করতে ক্লান্ত হন না?’
‘না বাবা। এ কাজটা করতে আমার অনেক ভাল লাগে। এ গাছটারেও অনেক ভাল লাগে। এক দিন দুইটা পিচ্চি মেয়ে আর ছেলে আইসা মাঠে এ জবা ফুল গাছটার চারা লাগাইছিল। মেয়েটা আর ছেলেটারে আমি কথা দিছিলাম যে, এরপর থেকে গাছটার দেখাশোনা আমি করমু। কথাটা শুইনা মেয়েটা একটা হাসি দিছিল। সেই হাসি চান্দের আলোর মতন সুন্দর। এরপর সেই দিন থেইকা আইজ পর্যন্ত প্রতিদিন এ গাছে আমি পানি দেই, যত্ন করি। মেয়ে আর ছেলেটারে দেখতে অনেক ইচ্ছা করে। এক বার গেছিলাম তাগো বাসায়। যাইয়া মেয়ে আর তার বাবা কাউরে পাই নাই। দরজায় তালা মারা। পাশের বাসায় ছেলেটা থাকত। সেখানেও দেখি সে আর তার পরিবারের লোকজন নাই। নতুন ভাঁড়াটি আসছে। তারপর আর তাদের দেখা পাই নাই। উপরওয়ালার কাছে দোয়া করি, তারা যেখানেই থাকে জানি ভাল থাকে।’
রাজু একটা হাসি দিয়ে পিছনে ফিরে বলে,
‘তারা যেখানেই থাকুক, ভাল থাকুক।’
রাজু যাওয়ার সময় লোকটা তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রাজু ঘাড় ফিরিয়ে ওনাকে বলল,
‘ভালো থাকবেন।’
এরপর রাজু হাঁটতে হাঁটতে মাঠের বাইরে চলে আসে। এখন মাঠের পাশ দিয়ে পথচারীর পথ দিয়ে হাঁটছে সে। রাস্তা-ঘাট ফাকা। এখনো মানুষ জনের চলাচল শুরু হয় নি। হাঁটতে, হাঁটতে রাজু তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকাল। পকেটে হাত দিয়ে হাঁটা তার অভ্যাস। ডান পকেটে কোন একটা বস্তুর স্পর্শ পাওয়ায় সে থেমে গেল। পকেট থেকে বের করে জিনিসটা দেখল। দেখে সেটা তার পিছনের পকেটে রাখল। রাজু ভাবল,
‘কিছু কিছু জিনিস না জানাই ভাল। সব কিছু জানতে হয় না।’
আকাশে সূর্য উঠেছে। সূর্যের আলো রাজুর মুখে পড়েছে। তার মুখে একটা নিশ্চিন্তের হাসি। আজ লাল, নীল, হলুদের এ পৃথিবীটাকে অন্য রকম সুন্দর লাগছে তার।
দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটছে রাজু। তার পেছনের পকেটটার বাইরে ঝুলে আছে, সোনালী রঙের একটি চেইন।
(শেষ)