কুমিল্লা (দক্ষিণ): কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন এটি, যা সবার কাছে কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। ১৩৭ বছরের পুরোনো সেই কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণ-পাঠাগারটি আজো শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রদীপ ছড়াচ্ছে। অবিভক্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের স্মৃতি বহন করা এ টাউন হলটি কুমিল্লাবাসীর গৌরবেরও প্রতীক। কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এ টাউন হল। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সিটির প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে অবস্থিত এ টাউন হলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে কুমিল্লার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর্থসামাজিক ও কল্যাণমুখী নানা কাজ। এখানে পদধূলি পড়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ ও সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত মহাত্মজনের।
শতাব্দীরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত এ পাঠাগারটি জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে চলছে নিরবধি। গণপাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার পর বর্তমান পর্যন্ত সময়ে রয়েছে সমুজ্জ্বল ও বিশদ ইতিহাস। তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজার জমিদারি ছিল কুমিল্লাতে। এ বীরচন্দ্র গণপাঠাগারটিতে তখন মহারাজার কাছারি বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হত। মহারাজার নায়েব-গোমস্তারা এ কাছারি বাড়িতে থাকত। ত্রিপুরার মহারাজ দানবীর শ্রী বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের মহানুভবতায় কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে দশ বিঘা জমির উপর একটি ভবন নিজস্ব অর্থায়নে করে দেন। ১৮৮৫ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠিত, ওই ভবনই কুমিল্লার গণপাঠাগার। চলতি শতাব্দীতে এ পাঠগারের সামনে শহীদ মিনার গড়ে উঠে। শহীদ মিনারের পাশে স্থাপন করা হয় মুক্তমঞ্চ। রয়েছে একটি মিলনায়তনও, যা নগর মিলনায়তন নামে পরিচিত। দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনের মূল ফটকের ফ্লোরে সারি সারি টেবিলের উপর দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকাগুলো সাজানো রয়েছে। পাঠকের জন্য পত্রিকা পাঠের সময় সকাল দশটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। ভবনের সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে তাকে তাকে সাজানো রয়েছে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রকাশিত সৃজনশীল গবেষণালব্ধ অজস্র বই। এ পাঠাগারটিতে বসেই পাঠকদের বই পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে গবেষণার জন্য পাঠাগারের আলাদা কক্ষে বই পড়ার সুব্যবস্থা। পাঠাগারে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রাজমালা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনীষীদের রচনাসমগ্র রয়েছে। এখানে বাংলা ভাষার ২৪ হাজার বই ও ইংরেজি ভাষার ছয় হাজার বই রয়েছে। ৩০ হাজার বই দিয়ে ৬৩টি আলমারি সজ্জিত। সদস্যরা একসাথে এক সপ্তাহের জন্য তিনটি বই নিতে পারেন। তা ছাড়া সংরক্ষিত গ্রন্থগুলো পাঠাগারে বসে পাঠ করা যায়। টাউন হল ভবনের দ্বিতীয় তলায় যে কেউ গেলে সেখানে অধ্যয়ন করতে পারবেন। যে কেউ চাইলে পুরোনো পত্রিকার কপি দেখতে পারেন। গণপাঠাগারের সামনের অংশটি সবুজ চত্বর। প্রতিদিন বিকাল ও সন্ধ্যায় স্থানটা থাকে আড্ডামুখর। সবুজ ঘাসে বসে কেউ গলা ছেড়ে গান ধরেন। কেউবা করেন আবৃত্তি। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন কুমিল্লা টাউন হলে এ চিরচেনা এক দৃশ্য। এ যেন কুমিল্লাবাসীর নিশ্বাস নেয়ার এক টুকরো শান্তিনিকেতন।
কবি ও লেখক পিয়াস মজিদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে এ টাউন হলকে ঘিরে। তিনি বলেন, ‘বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন কুমিল্লার প্রত্নতত্ত্বের ঐতিহাসিক এক নিদর্শন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের হাতে প্রতিষ্ঠিত এ স্থাপনা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সেতুবন্ধন। বীরচন্দ্র গণপাঠাগারে রয়েছে সেরা সব বইয়ের সংগ্রহ। অনেক বড় বড় মনীষী এখানে এসে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। এ টাউন হলের মঞ্চেই নাটক করেছেন ভাষাসংগ্রামী লায়লা নুরসহ অসংখ্য গুণী শিল্পী। দুই বাংলার অনেক আবৃত্তি শিল্পী এ টাউন হলের মঞ্চে এসে আবৃত্তি করেছেন।’
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমার জীবনের অনেক সময় কেটেছে এ টাউন হলকে ঘিরে।’
ইতিহাসবিদ ও কুমিল্লা টাউন হলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসানুল কবীর বলেন, ‘১৮৮৫ সালের ৬ মে নগরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে কুমিল্লা টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয়। টাউন হলের প্রতিষ্ঠাতা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর। দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে ভবনটি নির্মিত। ১৯৩০ সালে এটিপ্রথম সংস্কার করা হয়। ২০০২-০৩ সালে এটি ফের সংস্কার করা হয়। বিভিন্ন সময় কুমিল্লা টাউন হলে উপমহাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বক্তৃতা করেন। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শেখ মুজিবুর রহমান, সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শেখ হাসিনা ও অন্যন্য সরকার প্রধানেরা এখানে বক্তব্য রেখেছেন। কুমিল্লার আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু এ টাউন হল। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা আট শতাধিক। প্রতি দুই বছর পরপর নির্বাচন করা হয়। এতে সাধারণ সদস্যরা ১৫ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত করেন। নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে একজন সহসভাপতি, একজন সাধারণ সম্পাদক, দুইজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে এ কমিটির সভাপতি। তবে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন সাধারণ সম্পাদক।’
টাউন হলটির সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হলের মিলনায়তনের অবস্থা জরাজীর্ণ। মিলনায়তন নিচু হওয়ায় এতে পানি ঢোকে। ফলে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’
এ দিকে, ১৩৭ বছরের পুরোনো সেই বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনকে ভেঙে নতুন স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে প্রশাসন। এ নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতি কর্মীরা সমালোচনামুখর হয়েছেন। তাদের দাবি- টাউন হলটি ভেঙে ফেলা হলে কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্যে আঘাত করা হবে। তাদের ভাষ্য, সবাই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা চায়, উন্নয়ন চায়। তবে সেটা ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে নয়। গত বছর বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনকে ভেঙে আধুনিকরূপে সাজানোর বিষয়ে কুমিল্লার বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সুধীজনদের সাথে মত বিনিময় সভা করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, কুমিল্লা সদর আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন কুমিল্লার সাবেক জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর।
এ বিষয়ে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘সাত বছর ধরে টাউন হলের আধুনিকায়ন নিয়ে কাজ করছি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আশ্বস্ত করেছে। আশা করছি, সুন্দর একটি স্থাপনা হবে। আর কুমিল্লার মানুষ আমাকে সহযোগিতা করলে দ্রুত এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে।’
তবে বৈঠকে উপস্থিত সুধীসমাজের অনেকেই মত দিয়েছেন- টাউন হল ভবনের স্থাপত্যশৈলীটি ঠিক রেখে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক।
এ নিয়ে মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘বহুতল ভবন নির্মাণ নিয়ে সংস্কৃতি প্রেমী ও কুমিল্লাবাসীর মতামত সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।’