শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

শিরোনাম

৩১ ডিসেম্বর ১৬তম মৃত্যু বাষির্কী: এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে শেফালী ঘোষ

শুক্রবার, ডিসেম্বর ৩০, ২০২২

প্রিন্ট করুন

আবছার উদ্দিন অলি: শেফালী ঘোষ একটি জনপ্রিয় সংগীত শিল্পীর নাম। এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে শেফারী ঘোষ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রানী উপাধি পেয়েছেন। চট্টগ্রামসহ সারা দেশ তথা বিদেশেও সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছেন শুধুমাত্র আঞ্চলিক গান গেয়ে। এমন সৌভাগ্য কয়জন শিল্পীর ভাগ্যে জুটে। শেফালী ঘোষের কথা বার্তা ছিল সহজ সরল, চলাফেরা ছিল সাদামাটা। সহজ কথা বলা পছন্দ করতেন। স্বামী প্রয়াত ননী গোপাল দত্তও ছিলের সঙ্গীত অনুরাগী। একমাত্র ছেলে ছোটন দত্ত ছিল মায়ের মত সংগীত অনুরাগী। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী শেফালী ঘোষ চলে যান না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুর শূণ্যতা এখনো অপূরনীয়। ১৬তম মৃত্যু বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। চট্টগ্রামের সব শিল্পী সুরকার, গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার অপর আরেক জুটি শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আঞ্চলিক গানের এ জনপ্রিয় জুটি আমাদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান।

আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী উপমহাদেশ খ্যাত শিল্পী শেফালী ঘোষের গান এখনো ফুরিয়ে যায় নি। তার সুখ্যাতি এখন দেশের মাটি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে পৌঁছে গেছে। শেফালী ঘোষের গাওয়া জনপ্রিয় গান এখনো শিল্পীরা কোথাও স্টেজ প্রোগ্রাম করতে গেলে গেয়ে শোনাতে হয়। এখনো শেফালী ঘোষের নামের ওপর ক্যাসেট চলে। শেফালী ঘোষকে নিয়ে রূপম চক্রবর্তী তৈরী করেছেন ডকুমেন্টারী ফিল্ম। তার গাওয়া গানের ভিডিও সিডি বাজারে ব্যবসায় সফল হয়েছে। তার মৃত্যুর পরেও নির্মিত হয়েছে আরো বেশ কয়েকটি গানের সিডি। এপার-ওপার বাংলায় শেফালী ঘোষ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন শুরু থেকেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ পর্যন্ত তাকে দেয়া হয় নি কোন জাতীয় পুরস্কার, দেয়া হয় নি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি। অবহেলিত ছিলেন চট্টগ্রামে থাকার কারণে। বড় বড় অনুষ্ঠানগুলোতে ডাকা হত না শেফালী ঘোষকে। শ্যাম সুন্দর ও শেফালী ঘোষ জুটি আঞ্চলিক গানের জগতে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কেননা এমন জনপ্রিয় জুটি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।

আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী শিল্পী শেফালী ঘোষের ৩১ ডিসেম্বর ১৬তম প্রয়াণ দিবস। তাই গভীর ভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আমাদের প্রিয় শিল্পী শেফালী ঘোষকে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার কানুনগোপাড়া গ্রামে ১৯৪৫ সালে জন্ম শিল্পী শেফালী ঘোষের। পিতা কৃষ্ণ গোপাল ঘোষ। সঙ্গীত জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন ছোটবেলা থেকে। ফলে স্কুল জীবন থেকে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে থাকেন এবং আর এগুনো সম্ভব হয় নি। তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও বিদেশে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, লন্ডনের রয়েল এলভার্ট হল ও কাতার, বাহারাইন, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কলিকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, বার্মা, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, জাপান, জর্ডান প্রভৃতি দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। লন্ডনের রয়েল এলভার্ট হলে তিনি গান পরিবেশন করে প্রশংসিত হয়েছেন। শেফালী ঘোষের ২০০ টিরও বেশি অডিও ভিডিও এ্যালবাম বাজারে রয়েছে। এছাড়া কলকাতা ও লন্ডনেও ক্যাসেট বের হয়েছে। শেফালী ঘোষ ব্যক্তিগতভাবে আঞ্চলিক গান গেয়ে তৃপ্ত হতে চান নি। চট্টগ্রামে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সাথে নিয়ে কাজ করতে গর্ববোধ করতেন। কারণ, চট্টলার ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে তথা সারা বিশ্বের বাঙ্গালীদের কাছে এ গানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শেফালী ঘোষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একজন শব্দ সৈনিক ছিলেন। বেতার ও টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণীর শিল্পী। তার সঙ্গীত শিক্ষা গুরু অনেকেই আছেন। স্কুল জীবন থেকে হাতে খড়ি বাবু তেজেন সেন, বাবু শিব শংকর মিত্র, বাবু জগদানন্দ বড়ুয়া, বাবু নীরদ বরন বড়ুয়া, বাবু মিহির নন্দী, বাবু গোপাল কৃষ্ণ চৌধুরী প্রমুখ ওস্তাদদের কাছে থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছেন। পরবর্তী এমএন আখতার, এমএ কাশেম, আবদুল গফুর হালী ও সৈয়দ মহিউদ্দিন প্রমুখ গীতিকার ও সুরকারদের কাছ থেকে আঞ্চলিক গানের শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়া বিশেষ করে স্বামী বাবু ননী গোপাল দত্ত সংগীতের ব্যাপারে গান বাছাই, গানের সুর, গানের কথা ইত্যাদি নিপুনভাবে সব ধরনের সহায়তা করতেন।

তাদের সেই শূণ্যতা পূরণে আরেক গুনী শিল্পী সনজিত আচার্য্য ও কল্যাণী ঘোষ জুটি বেঁধে এখনো দর্শক শ্রোতাদের সংগীতের আনন্দ দিয়ে থাকেন। গীতিকার ও সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিন শেফালী ঘোষের হাতে আজকের আরেজ জনপ্রিয় আরেক শিল্পী শিমুল শীলকে তুলে দেন। ওরে সাম্পান ওয়ালা, ছোড ছোড ঢেউ তুলি, বাইক্কা টেয়া দে, শেফালী ঘোষের জনপ্রিয় মিউজিক ভিডিও দর্শকদের চাহিদা পূরণে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। শেফালী ঘোষের অধিক সংখ্যক মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেছেন নাট্যজন ও গুনী পরিচালক শেখ শওকত ইকবাল চৌধুরী। শেফালী ঘোষে শিল্পী জীবনে কখনো কারো সাথে দরকষাকষি করেন নি। এমনকি বলেন নি আমাকে এত টাকা দিতে হবে। যখন যে যেমন সম্মানী দিয়েছেন, তিনি তা নিয়েছেন। এতে কখনো কখনো আয়োজক তথা অডিও কোম্পানি এ শিল্পীকে ঠকিয়েছেন। দেশের বাহিরে অনুষ্ঠানে তার ডিমান্ড থাকলেও ঢাকায় বসে অনেকে তাকে নানা অজুহাতে অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত করেছেন। তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় এমনটি অভিযোগ করেছিলেন আমাকে কাছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গান করে এমন জনপ্রিয়তা পাবেন তা শেফালী ঘোষেরও জানা ছিল না। তিনি প্রায়শ বলতেন, আমার চট্টগ্রাম আমার জন্য অহংকার। কে আমাকে ঠকাল, কে আমাকে পয়সা কম দিল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার গান মিশে আছে সব মানুষের অন্তরে, সবাই আমাকে ভালবাসে, এটি কোটি টাকার পাওয়ার চেয়ে বেশি।

১৯৬৪ সালে সর্বপ্রথম রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রে নজরুল সংগীতে তার নাম তালিকাভুক্ত করে। বেতারে তার প্রথম সংগীত পরিবেশিত হয় ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে..’ এ গানটি। ১৯৭০ সালে সর্ব প্রথম টেলিভিশনে তার গান স¤প্রচার করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করেন। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেন। ১৯৭৪ সালে শেফালী ঘোষ প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন। ১৯৭৮ সালে লন্ডনের প্রখ্যাত মিলফা লিমিটেড তার গানের ১০ টি ক্যাসেট এবং লংপ্লে বের করে। ১৯৭৯ সালে লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী রয়েল আলবার্ট হলে সংগীত পরিবেশন করেন। ঢাকা রামপুরা টেলিভিশনে কেন্দ্র উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তিনি গান গেয়ে ভূয়সী প্রশংসা পান। বসুন্ধরা, মধুমিতা, সাম্পানওয়ালা, মালকাবানু, মাটির মানুষ, স্বামী, মনের মানুষ, বর্গী এল দেশে প্রভৃতি চলচ্চিত্রে কন্ঠদান করেন।

শেফালী ঘোষের মধ্যে রয়েছে ওরে সাম্পান ওয়ালা, আইওরে আইওরে কুডুম, লাল মিয়ার বাড়ী, থিয়া থিয়া ও লেদুনী, ছোড ছোড ঢেউ তুলি, আসকার দিঘীর, ন জানি বাঁধিত বারি, শ্যাম রেঙ্গুম ন যাইও, ও মারে মা, মুখক্কা গইল্যা কালা, নাতিন বরই খা, মাইট্টা কলসি, বাইক্কা টেয়া দে, বানুরে জি অ বানু, নাইয়র নিবা কই, গোলাবী ইবাকন, আঁরে কিল্লাই ভাব পর, মালকা বানুর দেশেরে, এক্কান কথা দুছার, বন্ধু আর দুয়ারদি, পইরর পাড়দি গরবা, আঁর বাড়ীত যাইও, ওরে বাস কণ্ট্রাকটার।

আঞ্চলিক গানের মাটি ও মানুষের জীবনের নির্যাস মাখা বাণী ধ্বনিত হয় একেবারে খুঁটিনাটি নিভীড়ভাবে। যার স্বচ্ছ চিত্রকল্প সাধারণ মানুষকে তড়িৎ কাছে টেনে আনে। অথচ আধুনিক গানে তা অনুপস্থিত। আঞ্চলিক গানের শিল্পী হিসেবে শেফালী ঘোষ নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন। তিনি দীর্ঘ দিন চট্টগ্রাম শিল্পী কল্যাণ সংস্থার দায়িত্ব পালন করে গেছেন সুনামের সাথে। শেফালী ঘোষ ছিলেন, আছে, থাকবেন অনন্তকাল। ১৬তম প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি প্রিয় শিল্পী শেফালী ঘোষকে।

লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার, চট্টগ্রাম