যুক্তরাষ্ট্র/ইসরাইল: সম্প্রতি একটি টেলিভিশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রশ্ন করা হয়, ইসরাইল যদি গাজার রাফা এলাকায় স্থল হামলার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে? বাইডেনের পরিস্কার উত্তর ছিল, ‘আমি আর অস্ত্র দেব না।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্পর্কের মূল ভিত্তিই হল ওয়াশিংটনের অস্ত্র সরবরাহ। আর বাইডেন এ অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের ব্যাপারটিই সামনে এনেছেন। আসলে গাজায় ইসরাইলের হামলায় যে চরম মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা ঠেকাতে প্রবল চাপের মধ্যে রয়েছেন বাইডেন। তার সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গেল ৪০ বছরের মধ্যে প্রথম বারে মত দুই দেশের সম্পর্কে ফাটলের আভাস পাওয়া গেল।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক বিশ্লেষক ও মধপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, ‘গাজায় সংঘাত শুরুর পর থেকে রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে পড়েছেন বাইডেন। এক দিকে রয়েছে ইসরাইলের এককাট্টা সমর্থক রিপাবলিকান পার্টি, আরেক দিকে গাজায় ইসরাইলের হামলা নিয়ে বিভক্ত তার ডেমোক্রেটিক পার্টি। তবে, এখন পর্যন্ত বাইডেনকে দেখে মনে হয়েছে, ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নষ্ট হয়- এমন কিছু করতে চান না তিনি।’
টেলিভিশনে ওই সাক্ষাৎকার বুধবার (৮ মে) দিয়েছিলেন বাইডেন। এর পূর্ব পর্যন্ত ইসরাইলে অস্ত্রের একটি চালান স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই চালানে দুই হাজার পাউন্ড ও ৫০০ পাউন্ড ওজনের দুই ধরনের বোমা ছিল।
সোমবার (৬ মে) ইসরাইল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাফার পূর্বাঞ্চল লক্ষ্য করে তৎপরতা শুরু করেছে তাদের স্থলবাহিনী। এ এলাকার জনবসতিগুলোর কাছে ইসরাইলি ট্যাংকগুলোও জড়ো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা একের পর এক গোলাবর্ষণের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। সেখানে কোনরকমে টিকে থাকা হাসপাতালগুলোতেও আহত মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বার বার একই কথা বলছেন, রাফায় পুরো মাত্রায় স্থল হামলা চালানো হবে। সেখানে হামাসকে নির্মূলের জন্য এমন অভিযান প্রয়োজন। যুদ্ধবিরতির চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা সফল হোক বা না হোক, এ অভিযান হবেই। গাজায় সাত মাস ধরে চলা ইসরাইলের নির্বিচার হামলার মুখে এ রাফাতেই উপত্যকাটির দশ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে চরম মানবেতরভাবে জীবন কাটাচ্ছেন তারা।
রাফায় পূর্ণ মাত্রায় স্থল হামলা না চালাতে ইসরাইলকে অনেক বার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এলাকাটিতে ‘হামাসসংশ্লিষ্ট লক্ষ্যবস্তুগুলোতে সুনির্দিষ্ট অভিযান’ চালানোর জন্য চাপও দিচ্ছে। বিশ্লেষক অ্যারন ডেভিড মিলার মনে করেন, বাইডেন এটা ভেবে ভয় পাচ্ছেন যে, রাফায় স্থল অভিযান চালানো হলে গাজায় সংঘাত থামানোর বা হামাসের হাতে এখনো জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের মুক্তির ব্যাপারটি ঝুঁকির মুখে পড়বে। আর এ হামলা হলে ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেও বিভাজন বাড়বে। এসব ভেবেই অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের কথা বলে ইসরাইলকে একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন বাইডেন।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতি বছর ৩৮০ কোটি ডলারের অস্ত্রসহায়তা দিয়ে থাকে। এ ছাড়া, সম্প্রতি দেশটিকে আরো এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার অস্ত্র ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সরবরাহের প্রস্তাব পাস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে। তাই, ইসরাইলের হাতে বর্তমানে যে পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ আছে, তা দিয়েই তারা রাফাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা কর্নেল জো বুচিনো।
সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, ‘রাফায় হামলা চালানোর ইসরাইলের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের চালান স্থগিত করাটা তেমন একটা গুরুত্ব পাবে না। আসলে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বহু মানুষ উদ্বিগ্ন। তাদের সামাল দিতে অস্ত্রের চালান স্থগিত করাটা একটি রাজনৈতিক চাল।’
এ একটি চালান স্থগিত করাতেই চটেছেন রিপাবলিকান সিনেটররা। যেমন সিনেটর পিট রিকেটসের ভাষ্য, আমি মনে করি, অস্ত্রের চালান স্থগিত করাটা জঘন্য কাজ হয়েছে। প্রেসিডেন্টের আসলে এটা করার কোন দরকারই ছিল না।
অপর দিকে, অস্ত্রের চালান স্থগিতের সিদ্ধান্তে বাইডেনের নিজের দলের অনেকেই খুশি। যেমন সিনেটর ক্রিস কুনস। তিনি বলেন, ‘রাফায় হামলা থেকে নেতানিয়াহুকে বিরত রাখতে বার বার চেষ্টা করেছেন বাইডেন। এরপরও উত্তেজনা বেড়েছে।’
বাইডেন ও নেতানিয়াহুর সম্পর্ক পাঁচ দশকের। এ সম্পর্কে বলতে গেলে সব সময়ই টানাপোড়েন ছিল। দুইজনই যখন তরুণ ছিলেন, তখন একটি ছবিতে নেতানিয়াহুর উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি আপনাকে পছন্দ করি। তবে, আপনার কথার সাথে একমত নই।’
নেতানিয়াহুও প্রায়ই ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার জন্য বাইডেনের প্রশংসা করেন। আবার ফিলিস্তিনসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বহু ব্যাপারে একে অপরের বিরুদ্ধেও যান।
গেল ৭ অক্টোবব হামাসের হামলার পর ইসরাইলে ছুটে গিয়েছিলেন বাইডেন। ইসরাইলের প্রতি অকপট সমর্থন জানিয়েছিলেন। আবার সতর্ক করে এটাও বলেছিলেন, নাইন-ইলেভেনের হামলার পর আমরা যেসব ভুল করেছিলাম, সেই ভুলগুলো যেন আপনারা করবেন না।’ তিনি আসলে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, ফিলিস্তিনের মানুষজনও একইভাবে বড় দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। পুরো পৃথিবীর মতই নিরাপরাধ ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুতে আমাদের সমবেদনা রয়েছে।