ঢাকা: নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে অংশ নেয়া ২৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে চারটি দল ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। শর্ত সাপেক্ষে রাজি ছিল নয়টি দল। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনি রোডম্যাপে বলা হয়েছে, ‘১৭টি দল ইভিএমের পক্ষে।’ অথচ এর মধ্যে তিনটি রাজনৈতিক দল সরাসরি ইভিএমের বিরুদ্ধে বলেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ইভিএম নিয়ে কি অপকৌশলে জড়াচ্ছে নির্বাচন কমিশন? খবর ডয়চে ভেলের।
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য রোডম্যাপে সঠিকভাবে উঠে আসে নি। এ নিয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ‘নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে আমরা যে রাজনৈতিক দল ও তাদের কারিগরি বিশেষজ্ঞদের সাথে সংলাপ করেছি, তার পূর্ণাঙ্গ অডিও এবং ভিডিও আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। তাদের অডিও এবং ভিডিওতে থাকা বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। সেখানে যদি কারো বক্তব্য সঠিকভাবে প্রতিফলিত না হয় ও তারা সেটি আমাদের অবহিত করে, তাহলে নির্বাচন কমিশন অবশ্যই সেই বক্তব্যগুলো পুনরায় পরীক্ষা করে দেখবে।’
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা লিখিত বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন দেখিয়েছে, তারা ইভিএমের পক্ষে। তাদের বক্তব্য নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে পাল্টে গেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এমএ মতিন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে আমরা লিখিত বক্তব্য দিয়েছি। এখন যদি নির্বাচন কমিশন আমাদের বক্তব্য পাল্টে দেয়, তাহলে তারা সঠিক কাজ করে নি।’
এ ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের প্রতি আপনাদের আস্থা অটুট থাকবে কিনা জানতে চাইলে মতিন বলেন, ‘আমরা এখনই কিছু বলবে না। তারা তো নতুন এসেছে। আমরা আরো কিছু দিন তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। তারপর এ বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরবে।’
নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপে যে যুক্তি দেখিয়েছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে থাকায় তারা সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সংলাপে ২৯টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল ও বিকল্পধারা সরাসরি ইভিএমের পক্ষে বলেছে। তরিকত ও সাম্যবাদী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। বিকল্পধারার সাথে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমঝোতা ছিল।
নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে। সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জালাল উদ্দীন আহমদ বলেন, ‘সংলাপে আমরা বলেছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারের মাধ্যমে করতে হবে। তার অর্থ হল- আমরা ইভিএমের পক্ষে নই। নির্বাচন কমিশনের প্রকাশনায় যদি আমাদের ইভিএমের পক্ষে বলা হয়, তাহলে তারা সত্যি কথা বলে নি। তাহলে তো তাদের উপর আমাদের আর আস্থা থাকবে না। তারা তো আমাদের বলেছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গুরুত্ব দেয়া হবে। এখন দেখছি, সেটাও তারা করে নি।’
এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ইভিএমের পক্ষে থাকলেও তা শর্ত সাপেক্ষে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন শর্তগুলো বাদ দিয়েই তারা ইভিএমের পক্ষে বলে উল্লেখ করেছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা যে শর্তগুলো দিয়েছিলাম, সেখানে আমরা বলেছিলাম ইভিএম নিয়ে জনমনে অনাস্থা ও সংশয় আছে। ইভিএম ‘হ্যাক’ করা যায় না বলে ইসি যে দাবি করছে, তা প্রমাণিত নয়। পাশাপাশি কক্ষের দায়িত্ব পালন করা পোলিং অফিসারের হাতে যে দশ বা ১৫ শতাংশ ভোটারকে নিজের ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে ভোট দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেটা বাতিল করতে হবে। এসব শর্ত পূরণ না করলে ইভিএমের কোন কার্যকারিতা থাকবে না। এখন তো ভোটের ১৪ মাস বাকি। আমরা আমাদের কথাগুলো বলেই যাব।’
ইভিএম নিয়ে যে এত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, সেটা কতটা যৌক্তিক? এ প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, সেখানে কিন্তু কেউ এখন প্রমাণ করতে পারে নি এটা ত্রুটিপূর্ণ। আমরাই তো প্রথম ইভিএম তৈরি করেছিলাম, এখন যদিও উন্নত সংস্করণ এসেছে। তবে হ্যাঁ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, ইভিএমে ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল বা ভিভিপিএটি নেই। ভিভিপিএটি হচ্ছে, ভোটার ভোট দেয়ার পর ইভিএম থেকে একটি কাগজ বেরিয়ে আসবে। সেখানে কারো পরিচয় থাকে না। এতে ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখতে পাবেন। তবে কাগজটি ভোটার নিতে পারবেন না। এটা যুক্ত করা গেলে বিতর্কমুক্ত করা সম্ভব।’
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে ইসি। এখন তারা বলছে, ‘যন্ত্রটির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এর আগে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের শেষ দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না।’ তবে বুধবার নিজেদের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ অনুষ্ঠানে ইসি দাবি করেছে, সংলাপে বেশির ভাগ দলের মত ইভিএমের পক্ষে থাকায় এটি ব্যবহার না করা যুক্তিসংগত হবে না।
গত ৬ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে দেশের ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমব্যবহার না করার আহবান জানান৷ তারা ইভিএম ব্যবহারে ইসির নেয়া সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলেও উল্লেখ করেন। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইভিএম কিনতে বিপুল ব্যয় (প্রায় আট হাজার কোটি টাকা) কতটুকু যৌক্তিক, তা ভেবে দেখারও অনুরোধ জানান।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাল্টে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিবৃতিদাতাদের একজন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের মত একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যদি রাজনৈতিক দলের মতামত পাল্টে দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা প্রতারণামূলক কাজ, কোনেভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা তাদের আরো খতিয়ে দেখা দরকার। কেন এমনটি হল? এটার দায়ও নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে এটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অমর্যাদা। নির্বাচন কমিশন ইভিএমের ব্যাপারে যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে মনে হয়েছে এটি তাদের পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত। তারা তাদের মতামত রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’