ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বলেছেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের কোন ইস্যু নেই, সে কারণেই গেল মে মাসে তার সর্বশেষ সফরের সময় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোন বৈঠক করেননি।’
সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকার সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের বদলে এবার নারী ক্রিকেট দলের সদস্যদের সাথে চমৎকার সময় কাটানোর কথাও উল্লেখ করেন লু।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভয়েস অব আমেরিকার বাংলার প্রধান শতরূপা বড়ুয়া। সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ নিচে দেয়া হল-
প্রশ্ন: আপনার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে, আপনি বলেছেন বাংলাদেশে গেল ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হয় এবং দেশটিতে গণতান্ত্রিক ধারা উৎসাহিত হয়- এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কিছু উদ্যোগের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপারে এখন আর পেছনের দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের মাঝে আস্থার জায়গাটি ফিরিয়ে আনার বিষয়েও কাজ করার কথা বলেছেন। এটি কি বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত, যেখানে আপনারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনসহ গণতন্ত্র সুরক্ষা ও প্রসারের বদলে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও কৌশলগত দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগ দিতে চান?
ডোনাল্ড লু: আমার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের সময় আমি যেমনটি বলেছিলাম, আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে আছি, পেছনে নয়। আমরা বিস্তৃত পরিসরে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে আমাদের অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত ও আগ্রহী। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক আরো গভীর হবে। নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় আমরা আমাদের অভিন্ন স্বার্থকে এগিয়ে নিতে চাই। আমরা এরই মধ্যে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় একসাথে কাজ করছি। আমরা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে নিজেদের অভিন্ন অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে একসাথে কাজ করে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। সেইসাথে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন আমাদের জন্য একটি অগ্রাধিকার। আমরা সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ কাজকে সমর্থন করে যাব ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রাখব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশীল সমাজের একটি অংশ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ইস্যুতে, যার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারটিও রয়েছে, সে ব্যাপারগুলো নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি ‘নমনীয়’ ভূমিকা নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সমালোচনা করেছে। আপনি এ সমালোচনার বিষয়ে কী বলবেন?
ডোনাল্ড লু: যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে সমর্থন করে ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করার বিষয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পুরো নির্বাচনকাল জুড়ে আমরা নিয়মিত বাংলাদেশের সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ ও অন্যান্য অংশীজনদের সাথে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার কাজে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে তাদেরকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্তকারী সহিংসতার নিন্দায় আমরা সোচ্চার ছিলাম ও আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করতে ও যারা এসবের সাথে জড়িত, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্যও অনুরোধ করেছি। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আমাদের যোগাযোগ চালু থাকবে।
প্রশ্ন: আপনার সাম্প্রতিক সফরে আপনি সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে দেখা করলেও নির্বাচন বয়কটকারী বিরোধী দলগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেননি। আপনার সাম্প্রতিক সফরে কেন বিরোধী দলের সদস্যদের সাথে দেখা না করার সিদ্ধান্ত নিলেন?
ডোনাল্ড লু: এটা সত্য যে, গেল বছর নির্বাচনের পূর্বে আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে গোল টেবিল বৈঠকের সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা প্রাক-নির্বাচনের সময় নয়, তাই এবারের সফরে আমি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দেখা করিনি। এবার ঢাকায় থাকাকালীন আমার সৌভাগ্য হয়েছে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করার। এর মধ্যে ছিলেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাথেও আমি দেখা করেছি, যারা আমাকে বোলিং ও ব্যাটিং সম্পর্কে দুয়েকটি বিষয় শিখিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সাথে কাজ করার জন্য আপনার সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ লড়াইয়েরই একটি অংশ? আপনি কী (দুর্নীতিসংক্রান্ত) এ ইস্যুগুলো সমাধানের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা করার সদিচ্ছা নিয়ে সন্তুষ্ট?
ডোনাল্ড লু: আমি যখন আলবেনিয়া ও কিরগিজস্তান প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রদূত ছিলাম, আমরা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলাম। এটি তখনকার (আলবেনীয়) সরকারের কাছে জনপ্রিয় ছিল না, কিন্তু এখন সেই নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত প্রাক্তন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সকলে কারাগারে। পুরো পৃথিবীতে সমাজ দুর্নীতির বিচার দেখতে আগ্রহী। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও ২০ মে, আমরা ৭০৩১ (সি) ধারার অধীনে সাবেক জেনারেল আজিজ আহমেদের উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে ‘পাবলিক ডেজিগনেশন’ (এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা) ঘোষণা করি। দুর্নীতির এ অভিযোগগুলোর বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হবে বলে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা বিবৃতি দিয়েছেন, আমরা এ বিষয়টিকে স্বাগত জানাই।
প্রশ্ন: আমরা কি অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য উচ্চ-প্রোফাইলের বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপরও দুর্নীতির সাথে সম্পর্কিত এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারটি দেখতে পাব?
ডোনাল্ড লু: যখন আমাদের কাছে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকে, তখন আমরা পুরো পৃথিবীতেই নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা বিধিনিষেধের আকারে প্রকাশ্যে পদক্ষেপ নিই। আমাদের আইনগুলো আমাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ বা তাদের দুর্নীতির অর্থের গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট। আমি আশা করি, আমরা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে মিলে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে একসাথে কাজ করে যাব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ মে অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অংশ আলাদা করে পূর্ব তিমুরের মত একটি ‘খ্রিষ্টান’ জাতি-রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে। তিনি আরো দাবি করেছেন যে, তিনি যদি বাংলাদেশে একটি বিমানঘাঁটি স্থাপনের জন্য একটি দেশকে অনুমতি দিতেন, তবে গেল জানুয়ারিতে তাকে ঝামেলামুক্ত পুনর্নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন দেশের নাম উল্লেখ না করলেও, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশীয় গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করেই এ বক্তব্য দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘অফারটি এসেছে একজন সাদা মানুষের কাছ থেকে।… আমি যদি একটি নির্দিষ্ট দেশকে বাংলাদেশে একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দিতাম, তাহলে আমার কোন সমস্যা হত না’ যুক্তরাষ্ট্র কি কখনো বাংলাদেশে একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে?
ডোনাল্ড লু: এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। নির্বাচনের সময় আমাদের অগ্রাধিকার ছিল শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করা।
প্রশ্ন: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরীক্ষণের জন্য আপনি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিনামূল্যে স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশ এ বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? আপনার মতে, দুই দেশের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোন ক্ষেত্রগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত?
ডোনাল্ড লু: মে মাসে ঢাকা সফরের সময় প্রচণ্ড গরমে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি আমি নিজেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করেছি। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আমরা বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ক্লিন এনার্জি ক্যাপাসিটি গড়ে তোলা, কৃষি ও বিদ্যুতের মত খাতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো, জীববৈচিত্র্য বজায় রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে পরিবেশ সংরক্ষণের দিকে মনোনিবেশ করছি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের আলোচনা অত্যন্ত ইতিবাচক ছিল।
প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতে বাংলাদেশ কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে? এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো কী?
ডোনাল্ড লু: একটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, যা স্বাধীন ও উন্মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও স্থিতিশীল। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিষয়ে এমন একটা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। একটি গতিশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তাকে এ অঞ্চলের বাণিজ্য প্রসারের একটা সেতু এবং এ অঞ্চলে সমৃদ্ধির নোঙর হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা এ অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উন্নয়নে আমাদের বাংলাদেশি অংশীদারদের সাথে কাজ করার দিকে মনোনিবেশ করছি। এ ইস্যুগুলোসহ অন্য ইস্যুগুলোর সমন্বয়, আমাদের উভয় দেশের জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে।