চট্টগ্রাম: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা তো সকলেই সমর্থন দিচ্ছি। কারণ, এ পরিবর্তনে যেসব মৌলিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলোকে তো একটা ট্র্যাকে আনতে হবে। সুতরাং, আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং আশা করি, সামনের কাজগুলা যত দ্রুত সম্ভব তারা করতে পারবে।’
রোববার (১৮ আগস্ট) বিকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে গেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন।
আমীর খসরু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে বেষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর নেন। এর পূর্বে, দুপুরে তিনি সিটির প্রবর্তক মোড়ে ইসকন মন্দির পরিদর্শন করেন। ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে সার্বিক অবস্থার খোজ-খবর নেন। পরে তিনি অসকার দিঘির পাড়স্থ রামকৃষ্ণ মন্দির পরিদর্শন করেন। সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার পর মেহেদী বাগের বাসার সামনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন।
চমেক হাসপাতালে আমীর খসরু বলেন, ‘আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে যেভাবে গুলি করা হয়েছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তারা যে এখনো বেঁচে আছে, এটা আশ্চর্যের বিষয়। অনেকের অবস্থা এখনো জটিল, কঠিন সময় যাচ্ছে। তাদের পরিবারের কাজ কর্ম সব বন্ধ। ওরা তো সবাই এখন বিচারের অপেক্ষায় আছে। আমরা রাজনৈতিক জীবনে মনে হয় না, বাংলাদেশে ইতিহাসের এ ধরনের নির্বিচারে গুলি করে হত্যাকাণ্ড চলেছে। এ আহত লোকগুলো যারা আছে, তারা এখনো আল্লাহ রহমতে বেঁচে আছে। এদের বাকি জীবন কিভাবে কাটবে, এটাও একটা বিষয় আছে। তাদের অনেকে ভাল করে হাটা চলা করতে পারবে না। স্বাভাবিক জীবনযাপনও করতে পারবে ন। সুতরাং, এরা বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার অবস্থা তাদের থাকবে না।’
এ সময় তিনি আহতের দায়িত্ব এখন কে নেবে- এমন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘অনেকে অন্ধ হয়ে গেছে। অনেকের পা চলে গেছে আবার অনেকের পা থেকেও সেটি অবশ হয়ে গেছে। তারা হাটা চলা করতে পারবে না। এমন দুর্বিষহ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি করতে হলে এদের পুর্নবাসনের বিষয় আছে। আর জাতিরও তো পুর্নবাসনের ব্যাপার আছে। যে অবস্থায় আমরা গিয়ে পৌঁছেছি, এ রকম কিছু আমরা কোন দিন দেখিনি। এদের ত্যাগের বিনিময়ে যদি বাংলাদেশ সামনের দিকে এগুতে পারে, তবেই আমরা একটি নয়া বাংলাদেশ দেখতে পাব।’
দুপুরে ইসকন মন্দির ও রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে আমীর খসরু বলেন, ‘খালেদা জিয়া আমাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, বিএনপি সংখ্যালঘু বলে কোন শব্দে বিশ্বাস করে না। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধান সবাইকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেকটা নাগরিককে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সবক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে যারা বসবাস করে তাদের সবাইকে সমানভাবে দেখতে হবে। এটা নিশ্চিত করা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। যারা রাজনীতি করে সমাজনীতি করে সকলের দায়িত্ব, সব ধর্মের। আমি এখান থেকে বলব, চট্টগ্রামে যদি কোন হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ হয়, এটার দায় আমাদেরকে নিতে হবে। এ দায় কিন্তু এড়ানো যাবে না। আমার জানা মতে চট্টগ্রাম সিটিতে কোন মন্দিরে হামলা বা আক্রমণ হয়নি। আমি ঢাকা থেকে আমাদের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রেখেছি সব সময়। মন্দিরের ব্যাপারে আমি খোঁজ-খবর নিয়েছি। কমিটিও করা হয়েছে, তারা আমাকে ছবিও পাঠিয়েছে। আমি সেখান থেকে মনিটরিং করেছি।’
তিনি বলেন, ‘পরিচয়ের রাজনীতি আমরা করি না। আমাদের সবার পরিচয় হচ্ছে আমরা বাংলাদেশী। পরিচয় দিয়ে কোন রাজনীতি হয় না। অন্য পরিচয় এনে যদি বাংলাদেশের রাজনীতি করতে হয়, তাহলে যে পরিচয় এনে রাজনীতি করবে তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। কারণ, আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্প্রদায়িক যে চেতনা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাবনা, সম্প্রীতি পরস্পর সম্মানবোধ সেখান থেকে সরে যাওয়ার অন্য কোন সুযোগ নাই। সেই যুক্তির উপরে একটা স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে৷ সে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। সেই ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ স্বৈরাচার দুর্নীতিবাজকে বিতাড়িত করেছে। পরিচয়ের রাজনীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে খারাপ একটা চিত্র তৈরি করা হয়েছে। সেটা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। আপনাদেরকে ব্যবহার করে রাজনীতির যে একটা চিত্র তুলে দেয়া হয় সেটা তো ক্ষতিকর, লাভের কিছু হয় না।’
আমীর খসরু আরো বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ৬৫ শতাংশ মানুষ ২৫ বছরের নিচে বর্তমানে। এরা কিন্তু দুনিয়াদারি বুঝে ও জানে। সবার হাতে হাতে এখন একটা করে মোবাইল ফোন রয়েছে। সবাই সারা দুনিয়া দেখতেছে এখন। এর মধ্যে আমি এখানে বক্তব্য রাখছি একই সময়ে দুনিয়াতে আরো ৫০-১০০ টা বক্তব্য চলছে। আমার বক্তব্য ভাল না লাগলে দুই মিনিট পর সুইচ অফ করে আরেক দিকে চলে যাবে। মানুষকে আর বোকা বানানোর সময় নাই। সব কিছু বিশ্ব দেখেছে।’
তিনি বলেন, ‘খারাপ ভাল বিবেচনা করার যোগ্যতা আমাদের নতুন প্রজন্মের রয়েছে। যারা প্রাণ দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। আরো প্রাণ দিতে হলে আরো মারা যেত। আরো কিছু দিন থাকলে ৫০০-১০০০ জন আরো মারা যেত। কিন্তু, কেউ সরে দাঁড়াবে না। এ লোকগুলোর এ যে সেক্রিফাইস। এর পূর্বে গেল ১৭ বছর এখানে যারা আছে, সকলের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা রয়েছে। ৬০ লাখে উপরে মিথ্যা মামলা।’
আমীর খসরু আরো বলেন, ‘ভোট ও নির্বাচন এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে আমাদের কোন বিষয় নেই, এটা যার যার নিজস্ব চিন্তা। কিন্তু সেটাকে যদি রাজনীতিকরণ করে একটা গোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু, এটি যারা করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তারা তো নাই, অনেকে পালিয়ে গিয়েছে। সুতরাং, আমাদেরকে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে আমি ফের বলতে চাই, বাংলাদেশী চিন্তা চেতনামূলক যে রাজনীতি অন্তর্ভক্তিমূলক না রাজনীতি। এ চেতনা থেকে আমরা অতটুকু সরে দাঁড়াব না। আমি এটাও বলছি আপনাদেরকে, অন্য কোন জায়গায় যদি এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু, বাংলাদেশে আমরা হতে দেব না। আমি দৃঢ়ভাবে এ কথাটা বলছি।’
তিনি সকালে মেহেদী বাগের বাসার সামনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যে কাজগুলো করেছে, এগুলো করা যাবে না। চাঁদাবাজি করা যাবে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ভাগ বাটোয়ারা করা যাবে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলানো যাবে না। এখন রাজনীতি হবে আদর্শের রাজনীতি। রাজনৈতিক আদর্শকে মানতে হবে, জনগণের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। জনগণের পাশে থাকতে হবে। তাহলে আমাদের এ নতুন স্বাধীনতা সফলতা লাভ করবে। ধৈর্য ধরে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোন প্রকার গ্রুপিং করা চলবে না। এখন সুযোগ-সুবিধা নেয়ার জন্য অনেকেই বিএনপিতে আসার চেষ্টা করছে। তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কারো গায়ে হাত দেয়া যাবে না। তারা বাংলাদেশের নাগরিক, পাশের তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
এ সময় আমীর খসরুর সঙ্গে ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান, ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী, পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী, চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী শক্তিনাথানন্দজী, সাংবাদিক বিপ্লব পার্থ, রামকৃষ্ণ মিশনের সহ সভাপতি তাপস হোড়, প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দারুব্রহ্ম জগন্নাথ দাস ব্রহ্মচারী, মহানগর বিএনপির নেতা এমএ আজিজ, এসএম সাইফুল আলম, শফিকুর রহমান স্বপন, ইয়াছিন চৌধুরী লিটন, শাহ আলম, আবদুল মান্নান, জয়নাল আবেদীন জিয়া, মফিজুল হক ভুঁইয়া, আবুল হাশেম, আনোয়ার হোসেন লিপু, মন্জুর আলম চৌধুরী মন্জু, মো. কামরুল ইসলাম, মহানগর যুবদলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন দিপ্তী, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব খুরশীদ জামিল চৌধুরী, মেডিকেল কলেজ ড্যাবের সভাপতি জসীম উদ্দীন, জেলা ড্যাবের সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার তমিজ উদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার বেলায়েত হোসেন ঢালী, ড্যাবের নেতা ডাক্তার এসএম সারোয়ার আলম, প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী, উজ্জ্বল নীলাম্বর দাস ব্রহ্মচারী, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব ধর তমাল, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার আহ্বায়ক ঝুন্টু কুমার বড়ুয়া, সদস্য সচিব বাপ্পী দে, যুগ্ম আহ্বায়ক সুজন দাশ, সদস্য সুমন ঘোষ বাদশা।