ঢাকা: দেশের উন্নয়নের স্বার্থে তামাক কোম্পানির সব অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত সংশোধনের আহবান জানিয়েছে চিকিৎসক সমাজ।’
তারা বলেছেন, ‘সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে সিগারেট কোম্পানিগুলো নানা ধরনের বিভ্রান্তকর প্রচারণা চালাচ্ছে। ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের পর ২০১৩ সালে সংশোধনের প্রেক্ষিতে দেশে তামাক ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা দেশকে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সুস্থ্য জাতি উন্নত দেশের অন্যতম শর্ত, জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব না হলে দেশের উন্নয়ন ধরে রাখা সম্ভব হবে না।’
মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) বিকালে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব রেডিয়েশন অনকোলোজিস্ট, ইউনাইটেড ফোরাম এগেইন্স্ট টোব্যাকো ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি যৌথভাবে ‘জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকার, বিরোধীতায় তামাক কোম্পানি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ডিপার্টমেন্ট অব ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের গবেষক ডাক্তার মাহবুবুস সোবহান।
গণ মাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডসের (সিটিএফকে) লিড পলিসি অ্যাডভাইজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ সোসাইটি অব রেডিয়েশন অনকোলোজিস্টের প্রধান অধ্যাপক কাজী মোস্তাক হোসেন, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার মো. খোরশেদ আলম ও ডাসের উপদেষ্টা আমিনুল ইসলাম বকুল। এছাড়া তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিনিধি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ‘জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে তামাক ব্যবহার হ্রাস একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এ সময়ে আইন ও নীতির মাধ্যমে কঠোরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হলে, ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আর এ জন্য আমাদের মূল লক্ষ্য বর্তমান জনসংখ্যার অধিকাংশ তরুণদের ধূমপান শুরু হতে বিরত রাখা। ২০০৫ সালে আইনটি প্রণয়ন ও ২০১৩ সালে এ আইনটি সংশোধন হয়ছিল। ঠিক ঐ সময়ও তামাক কোম্পানি একইভাবে আইনের বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু এ সময়ে তামাক কোম্পানির ব্যবসায়ের লাভ কোন অংশ কমে নি। কর ফাঁকি ও আইনভঙ্গ করে ব্যবসায়ের কারণে দুইটি বিদেশি কোম্পানি দেশের তামাকজাত পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।’
তারা আরো বলেন, ‘বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত আইনভঙ্গ করে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি, কর ফাঁকিসহ নানা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ এখন তরুণ, তামাক কোম্পানিগুলো এসব তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক বার এ তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে পারলে তারা দীর্ঘস্থায়ী ভোক্তা পাবে। আর এ লক্ষ্যেই তামাক কোম্পানিগুলো সরকারের আইন সংশোধনের বিরোধীতা করছে। এ অবস্থায়, সরকারকে তামাক কোম্পানির এ ধরণের কূটকৌশল সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বক্তারা বলেন, ‘বাংলাদেশে মূলত দুইটি বিদেশি কোম্পানি দেশের তামাক ব্যবসায়ের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ কোম্পানিগুলো তাদের বাণিজ্য প্রসারের জন্য আমাদের দেশকে বেছে নিয়েছে। তারা শুধু এ দেশ থেকে লভাংশ্যই নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ দেশে যে রোগের ব্যয়, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি ও যে অর্থনৈতিক ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি, তামাক চাষের কারণে অন্যান্য ক্ষতির দায় কোনভাবেই তারা নেয় না। সুতরাং আমাদের তামাকের মত ক্ষতিকর পণ্যের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর পণ্য ক্রয় করতে মানুষকে উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বক্তারা আরো বলেন, ‘সরকার দেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। অপর দিকে তামাক কোম্পানি প্রতিনিয়ত তাদের ব্যবসায়ের বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে ধূমপায়ী বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে। সরকার ও তামাক কোম্পানির লক্ষ্য বিপরীত। সরকারের উদ্দেশ্য সংবিধানের দায়বদ্ধতা, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যয় কমানো। আর তামাক কোম্পানি লক্ষ্য মুনাফা।’
এ সময় বক্তারা বলেন, ‘তামাককে যে অর্থনীতির জন্য সহায়ক মনে করা হয় মূলত এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা ও মিথ। কারণ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক খাত থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে এ খাতে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা; যা মোট রাজস্বের চেয়ে আট হাজার কোটি টাকা বেশি। তামাক কোম্পানি অনেক বেশি রাজস্ব দেয় বলে যে দাবি করে তাও একটি মিথ। বিগত ২০২০ সালে একটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানি মোট ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছে দিয়েছে বলে দাবি করে। অথচ এর মধ্যে ২১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা জনগণের দেয়া ভ্যাট ও শুল্ক থেকে এসেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির দাবি করা রাজস্বের ৯৬ শতাংশই দিয়েছে ভোক্তা বা জনগণ। এ ভোক্তাদের তামাকের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণে উৎসাহী করতে তুলতে হবে।’