তেল আবিব, ইসরাইল: চলতি বছরের গেল অক্টোবরে ইরানের রাজধানী তেহরানের অদূরে পারচিনে অবস্থিত তালেঘান-২ নামের একটি গোপন পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ইসরাইল ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মাত্র তিন দিন পূর্বে প্রতিবেদনে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এক্সিওস। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর শেষ পর্যন্ত এ বিষেয়ে মুখ খোলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার পূর্ব পর্যন্ত অবশ্য এ হামলায় ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার বিষেয়ে এত দিন নিশ্চুপ ছিল ইসরাইলের কর্তৃপক্ষ।
গেল সোমবার (১৮ নভেম্বর) ইসরাইলের পার্লামেন্টে দেয়া বক্তব্যে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার ব্যাপারটি স্বীকার করেছেন নেতানিয়াহু।
তিনি বলেছেন, ‘ইরানের পরমাণু স্থাপনাও ছিল এ হামলার টার্গেট।’ এ ব্যাপারে ‘জেরুজালেম পোস্টে’ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ হয়েছে, ‘নেতানিয়াহু ইসরাইলের পার্লামেন্টে বলেছেন, এটা কোন গোপন বিষয় নয়।’
ইরানের পরমাণ কর্মসূচির কিছু নির্দিষ্ট অংশ টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছে।’ তবে, তিনি এ পরমাণু স্থাপনায় হামলার ব্যাপারে আর বিস্তারিত জানাননি।
ইসরাইলের হামলায় হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া ও হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে গেল ১ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। সব মিলিয়ে ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা টার্গেট করে দুই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে ইরান। এর উত্তরে গেল ২৬ অক্টোবর ইরানের অভ্যন্তরে পাল্টা হামলা চালায় ইসরাইল।
মূলত ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরাইল এসব হামলা চালানোর দাবি করলেও, সেসময় কোন জ্বালানি কিংবা পরমাণু স্থাপনাকে হামলার টার্গেট করা হয়েছে- এমন দাবি করা থেকে বিরত থাকে ইসরাইলের কর্তৃপক্ষ। তবে, এ হামলায় ইরানের তিনটি সোভিয়েত নির্মিত এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয় বলে দাবি করেন নেতানিয়াহু। অবশ্য নেতানিয়াহুর এসব দাবির ব্যাপারে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মন্তব্য জানায়নি ইরান।
তেহরান থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পারচিন মিলিটারি কমপ্লেক্সে অবস্থিত এ তালেঘান-২ গবেষণাগার। সেখানে ইরান অত্যন্ত গোপনে পরমাণু অস্ত্রের গবেষণা চালাচ্ছিলো বলে এক্সিওসের কাছে দাবি করেন ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। হামলায় পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছ সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ধ্বংস করা হয় বলে দাবি করেছেন তারা।
পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সমঝোতার অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে পরমাণু কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাগ করে ইরান। তার আগে দেশটির পরমাণু কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত পারচিন মিলিটারি কমপ্লেক্সে অবস্থিত এ তালেঘান-২ গবেষণাগারটি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির উদ্ধৃতি দিয়ে এক্সিওস জানায়, পরমাণু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরকের পরীক্ষাগার হিসেবে ইরান গোপন এ গবেষণাগারটিকে ব্যবহার করত।
পাশাপাশি, ইসরাইলের হামলায় বিধ্বস্ত তালেঘান-২ কমপ্লেক্স ভবনের স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিও রয়েছে বলে এক্সিওসকে জানায় ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি।
মার্কিন ও ইসরাইলের কর্মকর্তাদের দাবি, ইরানের কর্তৃপক্ষ পরমাণু অস্ত্রের গবেষণা চালানোর জন্য তালেঘান-২ গবেষণাগারটিকে এ জন্যই বেছে নিয়েছিল যেন কেউ এর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করতে না পারে। কারণ, এ কমপ্লেক্সকে সহজেই বেসামরিক উদ্দেশ্যের জন্য ব্যবহৃত গবেষণাগার হিসেবে দেখানোর সুযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে এক্সিওসকে যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘ইরানের বিজ্ঞানীরা সেখানে পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন প্রক্রিয়া যেন শুরু করা যায় সে ব্যাপারে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। গবেষণাগারটির বিষয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। ইরানের সরকারের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশই এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই এর অবস্থান সম্পর্কে জানত না।’
চলতি বছরের প্রথম দিকে প্রথম পারচিনে অবস্থিত এ গবেষণাগারটির তথ্য সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের গোয়েন্দারা প্রথম জানতে পারে বলে জানায় এক্সিওস। ইরানের বিজ্ঞানীরা সেখানে পরমাণু অস্ত্রে ব্যবহারের জন্য কম্পিউটার মডেলিং ও বিস্ফোরক নিয়ে গবেষণা করছিলেন।
এক্সিওস আরো দাবি করেছে, গেল জুন মাসেও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এ গবেষণাগারে সন্দেহজনক পরমাণু কার্যক্রমের ব্যাপারে ইরানকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তবে, তাদের ধারণা ছিল, ইরান এ সতর্ক বার্তাকে আমলে নিয়ে সেখানে কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে। কিন্তু, ইরান তা না করে গবেষণা চালিয়ে যায়।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা উত্তরে ইসরাইল এ তালেঘান-২ গবেষণাগারকে নিজেদের হামলার টার্গেট হিসেবে ধরে নিলেও অবশ্য এ ব্যাপারে সায় দেননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের।
এ ব্যাপারে এক্সিওস জানায়, ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার উত্তরে ইরানের পরমাণু স্থাপণায় ইসরাইল যেন পাল্টা হামলা না চালায় সেজন্য নেতানিয়াহুকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন জো বাইডেন। ইরানের পরমাণু স্থাপনায় ইসরাইলের হামলায় মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই জো বাইডেন ইসরাইলকে এ হামলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
যেহেতু তালেঘান-২ গবেষণাগারটি ইরানের স্বীকৃত পরমাণু গবেষণাগার নয়, সেহেতু সেখানে হামলা হলেও ইরান তা ফাঁস করতে চাইবে না বলেই ধরে নিয়েছিল ইসরাইল। কারণ, সেখানে পরমাণু স্থাপনা থাকার বিষয়টি ইরান স্বীকার করে নিলে তা হবে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইরানের সাথে সই হওয়া পশ্চিমাদের পরমাণু চুক্তির লঙ্ঘন। এ পরিস্থিতিই মূলত ইসরাইলকে ইরানে হামলার টার্গেট হিসেবে এ তালেঘান-২ গবেষণাগারকেই বেছে নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে।
পাশাপাশি, তালেঘান-২ গবেষণাগারে হামলা চালিয়ে ইসরাইল ইরানকে এ বার্তা দিতে চেয়েছে যে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা অবহিত এবং এমনকি গোপন গবেষণা কার্যক্রমও তাদের নখদর্পণে।