শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫

শিরোনাম

পিলখানা হত্যা: নির্মমতার বর্ণনা দিলেন স্বজনরা, করলেন ‘খুনীদের’ আড়ালের চেষ্টার অভিযোগ

বুধবার, জানুয়ারী ২৯, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

ঢাকা: পিলখানায় ১৬ বছর আগে সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা তুলে ধরে নিহত কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য ও বেঁচে ফেরা কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বয়ান পাল্টে এ হত্যাযজ্ঞের দায় শুধু ‘ভারত ও শেখ হাসিনা’র ওপর চাপিয়ে সরাসরি জড়িতদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে।

বুধবার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তারা নতুন করে আন্দোলন গড়ে তুলে এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না, কেউ কেউ ’খুনীদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে কী না‘-সেই প্রশ্নও তোলেন।

জামিনে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বিডিআর জওয়ানদের ঘিরে সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেন স্বজনরা। তাদের শঙ্কা, আটক বিডিআর জওয়ানদের মুক্তি নিয়ে যে অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে, তাতে এ হত্যাকাণ্ডের সব অপরাধীকেই ছেড়ে দেওয়া হতে পারে।

নিহত কর্মকর্তাদের স্বজনদের ভাষ্য, সেদিন বিডিআর জওয়ানরাই কর্মকর্তাদের হত্যা করার পর উল্লাস করেছে, লাশ বিকৃত করেছে, অফিসারদের পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের বাসস্থানে ধ্বংসযজ্ঞ-লুটপাট চালিয়েছে। এখন সেই বয়ান পাল্টে বলা হচ্ছে শুধু শেখ হাসিনা আর ভারত এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যাকাণ্ডে তাদের ইন্ধন থাকতে পারে; তবে জওয়ানরা যে সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিল বেঁচে ফেরা কর্মকর্তা ও স্বজনরা তা নিজেরাই দেখেছেন।

বুধবার ঢাকা উত্তর সিটির মহাখালীর রাওয়া ক্লাবের অ্যাঙ্কর হলে ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবারবর্গ ও বেঁচে ফেরা সেনা অফিসারদে’র যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তারা।

প্রায় দেড় ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে শহীদ পরিবারের সদস্য ও বেঁচে ফেরা অফিসাররা তাদের দেখা নির্মমতার বর্ণনা দেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজধানীর পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের সদরদপ্তরে দেশ-বিদেশে আলোড়ন তৈরি করা ওই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। তখন এ ঘটনাকে বিডিআর বিদ্রোহ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল।

এর আগে গত ৭ জুন রাওয়া ক্লাবে পিলিখানার এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত নতুন তদন্ত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান বলেছিলেন, ২০০৯ সালের ওই সময়ে বিডিআরে কোনো বিদ্রোহ হয়নি; ওটা ছিল সেনা কর্মকর্তাদের ‘হত্যার একটি ষড়যন্ত্র’।

বিডিআরের সদরদপ্তরে দুই দিন ধরে সংঘটিত ওই ঘটনাকে ‘পলাশীর যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি’ হিসেবেও বর্ণনা করেন বিডিআরের সাবেক এই মহাপরিচালক; যাকে সপ্তাহ দুয়েক আগে তদন্ত কমিশনের প্রধান করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

ক্ষমতার পালাবদলের পর পিলিখানা হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তের জোরালো দাবির মধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর সাত সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তিন মাসের জন্য সময়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে তাদেরকে।

কমিশনের প্রধান ফজলুর রহমান ২০০০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০১ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত বিজিবির প্রধান ছিলেন।

সেদিন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের আর্মি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল আর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মিলে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে।’

তদন্ত কমিশনের কাজ শুরু এবং এ ঘটনার পুনতদন্তের দাবির মধ্যে গত ১৯ জুন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলায় দেড় শতাধিক আসামি জামিন পান। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এই সদস্যরা হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে প্রায় ১৬ বছর ধরে কারাগারে আটকে ছিলেন।

এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার এ যৌথ সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। এটি সঞ্চালনা করেন নিহত কর্নেল কুদরত এলাহির ছেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও আইনজীবি সাকিব রহমান।

শুরুতেই তিনি বলেন, ‘পিলখানায় সেদিন কী পরিমাণ নির্যাতন করা হয়েছে, কী পরিমাণ নিপীড়ন করা হয়েছে অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আমরা সেটাই বলব। তারা (জওয়ানরা) কী বর্বরতার পরিচয় দিযেছে সেই জিনিসটা আপনাদের শোনানো হবে। আমরা কোনো দাবি করব না আজকে, বিচারেরও দাবি করব না। আমরা চাইব জনগণ ও মিডিয়া নিজেরা বিচার করুক আসলে তারা কাদেরকে নিরপরাধ বলছে।’

কী করে এখন জওয়ানদের ‘নিরাপরাধ’ বলা হচ্ছে সেই প্রশ্ন রেখে সাকিব বলেন, ‘একটা মানুষ যদি বন্দুক ধরে তাহলেই সেটা মিউটিনি, সেটা বিদ্রোহ। শুধু যদি সেটা ব্রিদোহ হত…বিষয়টা তো এমন না। তারা খুন করেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বারবার বলা হচ্ছে একটা ন্যারেটিভের কথা, যে শুধুমাত্র শেখ হাসিনা আর ইন্ডিয়াই বুঝি এটা করিয়েছে। তারা করাতে পারে, হতে পারে তারা করিয়েছে- সেটা কমিশনকে বের করতে দেন। যথেষ্ট অ্যাভিডেন্স আছে আমাদের। কিন্তু এটা করেছে যারা তাদেরকে আপনারা (জেল থেকে) বের করে দেবেন? এটা কী সম্ভব?’

‘ন্যারেটিভ চেঞ্জ করা এটা কোনো মুখের কথা না। এত বড় খুন, এত বড় হত্যার পর ন্যারেটিভ চেঞ্জ করবেন আমরা বেঁচে থাকতে এটা মেনে নেব না। একেকটা পরিবারকে মারতে মারতে, বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে যে কোয়ার্টার গার্ডে নেওয়া হয়েছিল- কারা নিয়েছিল সেটা? ইন্ডিয়ানরা এসে নিয়েছিল না শেখ হাসিনা নিজে এসে নিয়েছিল, বলেন আপনারা সেটা।’

এ ঘটনা নিয়ে ৫ আগস্টের পর নতুন করে আন্দোলনের প্রশ্ন তুলে সাকিব বলেন, ‘আমরা কখনো রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট দিই না। আমি একজন শিক্ষক। আমাদের ছাত্ররা, যাদের পাশে আমরা ছিলাম। আমাদের একজন শহীদ অফিসার লে. কর্নেল রবির ছেলে এই অভ্যুত্থানে গুলি খেয়েছে। এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাদের দেখছি তারা হয়তো সেসময় অনেক ছোট ছিল। কিন্তু তারা এই জিনিসটাকে কোথায় ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? তারা খুনীদের সাথে কীভাবে দাঁড়ায়?’

‘একজন আইনজীবি হিসেবে স্পষ্ট করতে চাই যে, যাদের বিচার বিভাগ জামিন দিয়েছে সে বিষয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। আমরা শঙ্কিত যেভাবে ঢালাও সকল বিডিআর সদস্যদের মুক্তির দাবি করা হচ্ছে এবং সেটা ইনক্লুডিং যারা কী না ডেথ রোতে রয়েছে এবং যাদের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। আমরা এটা নিয়ে অনেক কনসার্ন এবং ভীত যে আমাদের বাবাদের খুনীদের (জেল থেকে) বের করে দেওয়া হবে কি না।’

তার বক্তব্যে সমর্থন দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন বিডিআর হাসপাতালের তৎকালীন চিকিৎসক নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডাক্তার লুৎফুর রহমান খানের মেয়ে ডাক্তার সাবিহা বুশরা প্রমি।

তিনি বলেন, ‘আমিও সেই প্রশ্ন দিয়ে যাব। আমরা আই উইটনেস টেস্টিমনি দিচ্ছি। এর কাছে শুনছি, ওর কাছে শুনছি, ওমুক বলছে, ইন্ডিয়ান আসছিল, এই ইউনিফরম পড়া ছিল-এসব কিচ্ছু না। ইন্ডিয়া করাতে পারে, শেখ হাসিনা অর্ডার দিতে পারে কিন্তু এক্সিকিউট কারা করেছিল সেখানে। তাদের উল্লাসের মোটিভেশনটা কী ছিল?’

মুক্তি পাওয়া বিডিআর সদস্যদের নিয়ে আবেগের বাড়াবাড়ি চলার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আমার বাবাকে ৩২ জনের একটা গণকবরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল দুই দিন পর। আমার বাবার মুখে আমি পানি দিতে পারিনি। তিনি একটা গোসল পাননি মৃত্যুর পরে। এখন আমার শুনতে হয় যারা এখন তাদের বাবাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে তারা এখন ভিক্টিম। আমি এখন ক্যামেরার সামনে চীৎকার করতে পারছি না, আবেগ বিক্রি করতে পারছি না তাই এসব শুনতে হচ্ছে?’

‘আমার বাবার শেষ স্মৃতি হচ্ছে, একটা ড্রয়ার থেকে বের করে বাবাকে দেখানো হচ্ছে, যেখানে বাবার মুখ বিকৃত হয়ে আছে। আমার বাবার সাথে শেষ স্মৃতি ওটাই। হতে পারে কারো এজেন্ডা ছিল, হতে পারে কেউ হুজুগে কাজটা করেছে।’

তখনকার ১৪ বছরের কিশোরী ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘যখন গোলাগুলি শুরু হয় আমরা তখনো বুঝিনি। আমরা যখন বুঝতে পারি আসলে গোলাগুলি হচ্ছে তখন মা চিৎকার করে বাবাকে ফোন করে কাঁদছে ‘লুৎফর বাঁচাও’। বাবা তখনো বলছেন, ‘কিছু হবে না। তোমরা দরজা-জানালা আটকে বসে থাকো।’

‘এর কিছুক্ষণ পর জওয়ানরা এসে আমাদের দরজা ধাক্কায়। তারা এসে আমাদের বাসা থেকে চেনে-হিঁচড়ে মারতে মারতে নিয়ে যায়। তাদেরকে আমরা আঙ্কেল ডাকতাম। আমরা যখন বাসার নিচে নামি তখন একজন বিডিআর সৈনিক এসে আমার মায়ের বুকের মাঝখানে বন্দুকের নল ঠেকান। আমি আর আমার ছোটভাই ওনার পা জড়িয়ে ধরে বলি আঙ্কেল আমার মাকে কিছু করবেন না। আমরা কিছু জানি না, আমরা কোনো কিছু করি নাই। আমার মা চিৎকার করে বলতে থাকেন- আমার বাচ্চাগুলো ছোট, আমার স্বামী ডাক্তার। আপনারা আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দেন।’

এখন তাদেরকে নিরাপরাধ কেন বলা হচ্ছে এটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সাবিহা বুশরা বলেন, ‘এখন যেভাবে তাদের অসহায় হিসেবে দেখানো হচ্ছে তখন তাদের মুখের ভাষা আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কেমন ছিল তা আমরা বলতে পারছি না।’

সেদিনকার ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের যখন কোয়ার্টার গার্ডে নেওয়া হয় আমরা ভয়াবহ উগ্রতা দেখি। আমাদের মারা নিয়ে কী তাদের উল্লাস। একটা রুমে ৭০ থেকে ৮০ জন ছিলাম ভেতরে। ভেতরে অনেক মানুষ থাকায় ধাক্কা দিয়ে ঢোকানোর জন্য আমাকে পর্যন্ত মাথার পেছনে বন্দুকের বাট দিয়ে মারা হয়, আমি পেছনে বুটের লাথি খাই। আমার সাথে আমার যে বয়স্ক দাদা ছিল তাকেও লাত্থি দেয়।’

আবেগাপ্লুত বুশরা বলেন, ‘৩৬ ঘণ্টা ভেতরে নবজাতক শিশু ছিল, বাচ্চা ছিল, বৃদ্ধ ছিল কেউ এক ফোঁটা পানি খেতে পারেনি। আপনারা মনে করেন যারা খুনী তারাই শুধু অপরাধী। নিরীহ, নিরাপরাধ, নিরস্ত্র আমরা ছিলাম, আমাদের বাবারা ছিল।’

সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন বিডিআর এর ঢাকা সেক্টরের কমান্ডার নিহত কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী মেহরিন ফেরদৌসী বলেন, ‘বিগত ১৬ বছরে আমরা কিছু বলতে পারিনি, সঙ্গত কারণে। আজকে আমরা জনসমক্ষে এসেছি- যেন বিচার শুরু হয়। দোষীরা যেন শাস্তি পায়। যেভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি- ঢালাওভাবে এমন কি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মুক্তির জন্য যেভাবে আবেদন আসছে সেগুলো যেন সত্যি সত্যি না হয়। সেই শঙ্কায় আজকে আমাদের এই সংবাদ সম্মেলন।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন আমাদের নাম ধরে ধরে বাসায় এসে খুঁজছিল। বলছিল ওর ছেলেটাকে পেলে আগে হাত-পা ভাঙবে তারপর মারবে। এগুলো কিন্তু বাংলায় বলছিল, হিন্দিতে বা উর্দুতে বলেনি। এগুলো যারা বলেছিল তারা কী ক্রিমিনাল না, তারা তো ক্রিমিনাল মাইন্ডেই ছিল। আর আমার হাজব্যান্ডকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এসেছিল।’

বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারানো একমাত্র ব্যক্তি সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নানও সেখানে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একমাত্র যিনি হত্যাকাণ্ডে বাধা দিতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। আজকে এখানে আমার উপস্থিতি প্রমাণ করে এটা বিডিআর এবং সেনাবাহিনীর বিরোধ না। এটা হত্যাকারীর সঙ্গে নৃশংসতাকারীর সঙ্গে আমাদের বিরোধ।’

‘আমার বাবা হত্যাকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় তার বাহিনীর সদস্যরাই তাকে লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে, পেটে ক্ষতবিক্ষত করে, বার্স্ট ফায়ার করে পরে অফিসারদের সঙ্গে আমার বাবাকেও গণকবরে ফেলা হয়।’

‘আর আমরা ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর যখন দেখলাম শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেল তখন বিডিআর সদস্যরা ভিন্নভাবে প্রচার করতে শুরু করল যেন শেখ হাসিনা একাই ৫৭ জন অফিসারকে মেরেছে, একাই লাশ বিকৃত করেছে, একাই তাদের গণকবরে ফেলেছে। সেখানে আর কেউ ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা তো জানি, আমাদের বাবাদের কে বুলেট দিয়ে হত্যা করেছে, কে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েছে, কে গণকবরে ফেলেছে।’

বিডিআর হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফেরা বিডিআর হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডাক্তার সালাম পরে তদন্তেও জড়িত ছিলেন।

তিনি সহকর্মীদের ও তার ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দেন। বলেন, ‘সিভিলিয়ান ডাক্তার আমজাদ অফিসার্স কোয়ার্টারে থাকেন। তার বাসা অ্যাটাক হওয়ার পর তিনি দরজা খোলেননি। দরজা ভেঙে তার অ্যাবডোমেনে গুলি করেছে। আর আপনারা বলেন নিরাপরাধ।’

‘আরেক সিভিল ডাক্তার ফুয়াদ, রেডিওলজিস্ট। তাকে বাট দিয়ে মারা হয়। এখনো তার আই সাইট (দৃষ্টি) ফিরে আসেনি ঠিকমত।’

তিনি বলেন, ‘আমি সেদিন হিন্দি কথা শুনি নাই। এর পেছনে যেই দেশই থাক। কিন্তু এক্সিকিউট করেছে এরাই। এখন বলা হচ্ছে এরা নির্দোষ।’

বিডিআরের ইউনিট পর্যায়ের তদন্তকাজে যুক্ত এই কর্মকর্তার অভিযোগ, তৎকালীন বিডিআরের ডিজি তদন্তের অভিযোগপত্রে আসামি সংখ্যা কমাতে চাপ দিয়েছিলেন এবং অনেক কমিয়েও দিয়েছিলেন। এরপর শেখ হাসিনা সরকারের নিযুক্ত আইনজীবিরাও পরিবারগুলোর কাছ থেকে ‘টাকা খেয়ে’ আসামি তালিকা থেকে বাদ দেয়।

তার দাবি হত্যাকাণ্ডে জড়িত অনেক অপরাধী তো বিচারেই আসেনি। আর যারা এসেছে তাদের কোনভাবেই নির্দোষ বলার সুযোগ নেই।

আরেক বেঁচে ফেরা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রিয়াজ বলেন, ‘তারা আমাকে গলা টিপে মারার চেষ্টা করে, আমি কলেমাও পড়ে ফেলছিলাম। এখন আমাদের অনেকেই বুঝে না বুঝে সেদিনের খুনীদের পক্ষে বয়ান দিচ্ছে। ঘটনার দৃশ্যপট যেন পাল্টে যাচ্ছে। আজ রাজপথ থেকে মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে হত্যাকারীদের নির্দোষ আখ্যা দিতে সবাই ব্যস্ত। যেটা আমাদের অত্যন্ত অত্যন্ত ব্যথিত করে।’

‘সেদিন যারা বাইরে ছিলেন আজ তারা বিভিন্নভাবে বয়ান তৈরির চেষ্টা করছেন। কোয়ার্টার গার্ডে আমি দেখেছি আধা ঘণ্টার মধ্যে ২৭০০ অস্ত্র শুধু একটা অস্ত্রাগার থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল নারী-শিশুদের চীৎকার আরেকদিকে সৈনিকদের উল্লাস।’

তিনি বলেন, ‘বিপথগামী সৈনিকরা সেদিন ৫৭ জন অফিসারকে শুধু হত্যাই করেনি। লাশগুলোকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিকৃত করে। তারা বিডিআর হাসপাতালের পাশে একটি ট্রাকে লাশগুলোকে জড়ো করেছিল পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য। পরে একজন অবজারভেশন দেয় যে মুসলমানের লাশ পোড়ানো যায় না। পরে তারা লাশগুলোকে দুটো জায়গায় গণ মাটিচাপা দেয়।’

‘আমি শুধু পরবর্তী তদন্তের কথা বলব। আনিসুজ্জামান কমিশনের একটা তদন্ত হয়েছে, সিআইডির তদন্ত হয়েছে আর ইউনিট লেবেলের তদন্তগুলো আমরা করেছি। প্রতিটি তদন্তে যথাযথ স্বাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিআইডির কেইসগুলো হয়েছে। এখানে কারও নির্দোষ হওয়ার কথা না। বিভিন্নভাবে ক্রস চেক করা হয়েছে। একজন সৈনিক গুলি করেছে, অন্যরা তো দেখেছে।’

নিহত মেজর আব্দুস সালাম খানের বড় ছেলে সাকিব মাহমুদ খান সেই সময়ে পিলখানার ভেতরে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন সকালে তাকে, তার ১১ বছরের ছোট ভাইসহ সবাইকে মারতে মারতে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে আটকে রাখা হয়।’

‘৩৬ ঘণ্টা পর বের হয়ে বাবাকে খোঁজা শুরু হল। সিএমএইচে কিছু লাশ রাখা ছিল। আমরা সেখানে গিয়ে প্রথমে লাশটা দেখে শনাক্ত করতে পারি নাই। আমার বাবার দুজন কোর্স মেট ছিল। তারাও প্রথমে চিনতে পারে নাই। তারপর বাবার কোর্সমেটরা সাজেস্ট করেন আরেকবার দেখা উচিৎ। তারপরে গিয়ে আঙ্কেলরা আমাকে পয়েন্ট আউট করেন, ‘এটাই তোমার বাবার লাশ’।’

‘এখনো আমার বাবার কোনো স্মৃতি যখন মনে করার চেষ্টা করি সবার আগেই সেই স্মৃতিটা ভেসে উঠে। আমি বিচারের কোনো দাবি রাখছি না। জাতির উদ্দেশে বলছি আপনাদের বিবেকে যা বলে আপনারা তা করবেন।’

নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুল আরেফিনের স্ত্রী মুনমুন আখতার বলেন, ‘উপল- ৮ ভবনে আটটা অফিসার পরিবার থাকত। তাদের মধ্যে ছয়জন শহীদ হন। সেদিন আমার রাধুঁনীকেও (কুক) দেখি মাথায় লাল কাপড় পড়ে অস্ত্র হাতে উল্লাস করে। আমি সবাইকেই বাংলায় কথা বলতে শুনেছি। কোনো হিন্দি বা ইংলিশ কথা শুনি নাই।’