বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শিরোনাম

বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেন না আসে

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ১৩, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

গাজী তারেক আজিজ: দেখতে দেখতে ছয় মাস পার করলো অন্তর্বর্তী সরকার। পার করছে চরম বৈরী সময়। এরই মধ্যে ঘটে গেলো আরেক নির্মমতা। গুড়িয়ে দেয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তীর্থস্থান খ্যাত ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি। যে বাড়িতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্ব-পরিবারে হত্যাকান্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুসহ একই পরিবারের মোট ১৭ জন সদস্য শহীদ হন। এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিকট আত্মীয় আরও ৯ জন শহীদ হন। সর্বমোট ২৬ জনকে খুনিরা নৃশংসভাবে সে রাতে খুন করে। যা ছিল নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল (বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার), সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক প্রমুখকে খুন করে খ্যান্ত হয়নি খুনিরা।

প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত, এক আত্মীয় বেন্টু খান, আবদুল নঈম খান রিন্টুকে (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই) খুন করে। ওই সময় দেশে না থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

ভয়ঙ্কর সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর ওই সময় খুনিরা প্রকাশ্যে তাদের এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে স্বীকার করে। এ হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই বিচারের আওতায় যেন কোন দিন না আসে তাই দেশে নতুন আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ চালু করা হয়। যা ছিলো কালো আইন বলে খ্যাত। নির্মম এই হত্যাকাণ্ড যারা করেছে তাদের বিচারের আওয়াতায় না এনে উল্টো বিচারের পথ আইনগতভাবে রূদ্ধ করার বেআইনী প্রক্রিয়া জাতিকে করেছিলো কলুষিত।

শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্যই মূলত বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।

এতে করে তৎকালীন বিচার পাওয়ার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে বলে মনে করা হলেও আদতে তা হয়নি। ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সেই কালো আইন কিংবা বিচারহীনতার যে আইনানুগ সংস্কৃতি তা থেকেও দেশ, দেশের বিচার ব্যবস্থা ও বিচারালয় কলুষমুক্ত হতে পেরেছিল বলেও ধরে নেয়া হয়।

তথাপিও আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে হত্যা করে। তখন বুঝতে বাকি থাকে না, দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দেশ বিরোধী চক্র থেমে ছিল না। আর সেটা যুগে যুগে চলমান ছিল, আছে এবং থাকবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিকে ক্ষমতা থেকে হটানো কিংবা হটাতে চক্রান্ত করে দেশকে চরম অস্থিতিশীল করেও কেমন যেন এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে আরেক ধরণের লোক। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে হয় কৌশলী হতে হবে অথবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকা চাই।

যুগে যুগে এই ধরনের অবস্থা বা সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে শাসকদের কেউ কেউ এতটাই কঠোর ও কঠিন হয়েছে যে তা নির্মমতার মাত্রা অতিক্রান্ত করেছে। একটা পর্যায়ে তারা স্বৈরশাসক তকমা পেয়ে আরো বেশিমাত্রায় কঠোর হয়েছেন। সবার কেউ কেউ আরো বেপরোয়া হতেও দ্বিধা করেননি। এই পরিস্থিতি উৎরিয়ে কেউ মহান হতে পেরেছেন তেমনটা দেখা যায় না খুব একটা। আবার শাসকের রোষানলে পড়ে নিজেদের জীবন-যৌবন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এইসব নেতারা গণমানুষের রাজনীতি করে জীবন যৌবন উৎসর্গ করেছেন। তেমনই একজন ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি মানুষকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে আত্মবলিদান করেছেন স্বমহিমায়, স্বগৌরবে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে একটা স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড উপহার দিয়েছিলেন। আর এই সময়ে এসে তাঁকেও চরম দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পড়তে হচ্ছে! তা না হলে কেন তাঁর নিজের বাসভবন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও শেষে গুড়িয়ে দেয়া হয়। সভ্য সমাজ তো দূরে থাক, অতীতের সকল সংকটেও কেউ যে বাড়ির দিকে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করেনি, তাই হলো।

তারপর কি দেখলাম? মিডিয়ার অতি উৎসাহ যতটা না মানুষকে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে ঠিক ততটাই নজিরবিহীন পাহারাদারের ভূমিকাও ছিল লক্ষ্যণীয়। সেটা কেমন? প্রশ্ন থেকে যেতে পারে! তা হচ্ছে আরেক ধরনের গুজব রটিয়ে ফায়দা ওঠানো। যেমন ৩২ নাম্বারের সেই বাড়িটার পার্কিং বেজমেন্টে তথাকথিত আয়নাঘরের সন্ধান লাভের আশায় কথিত ভিউ ব্যবসায়ী অনলাইন মাল্টিমিডিয়ার ক্যামেরা। না হলে সুযোগ মতো সেখানটায়ও কোন না কোন হাঁড়গোড় রেখে আরেক গল্পের ফাঁদ পেতে মিডিয়ার খোরাক বানানো যেত! যা মিডিয়ার কল্যাণে আর হয় নি। দীর্ঘ কয়েকদিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আর হতাশ হয় তথাকথিত ‘মবকারীরা’। কিছুই পাওয়া গেল তো না-ই! একটা যেনতেন ছোট দুই তিন ইঞ্চি সাইজের হাঁড় নিয়েও গবেষণার কোন কমতি নেই! একেকজন যেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তা ভালো কথা!

পাশাপাশি সারাদেশে শুরু হলো ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা। গাজীপুরে হলো ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসায় অগ্নিসংযোগ আর লুটপাট করতে গেলে স্থানীয় জনতার দাবড়ানি খেয়ে পালাতে তো পারলোই না উল্টো হামকার শিকার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতা-কর্মীর। এতে ক্ষেপে যায় কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা ও স্থানীয় নেতাদের দাবী তারা সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়ি রক্ষা করতেই গিয়েছিল। আর হামলার শিকার হয়েছে। তারা ভাবতেই পারেনি এভাবে প্রবল বিরোধিতায় পড়তে হতে পারে! কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কর্মসূচি চলে। এই কয় দিনে আরো দেখা হয় ৩২ নাম্বারের ইট রডসহ খুলে নেয়ে যেতে।

সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের নামে সেনাবাহিনীসহ যৌথবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। ধরা হতে থাকে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের। বলা হয়েছিল গায়েবী মামলা হচ্ছে। হয়েছেও তাই। সরকারে থেকেই আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বললেন মামলায় নাম থাকলেই যেনতেন গ্রেফতার নয়। পুলিশ প্রধানও একই কথা বারবার বলেছেন। তথাপিও আমরা দেখছি অনেক নিরীহ লোককে ধরে উল্লেখিত গায়েবী মামলায় ফরওয়ার্ড করতে। পাশাপাশি যাদের নাম এজাহারে উল্লেখ করেছে কিন্তু অভ্যুত্থান তথা আন্দোলনে কোন ভূমিকা ছিল না তেমন লোকদের ধরে চালান করা হচ্ছে। এতে কি হচ্ছে? একটা পরিবার আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয়ে পড়ছে। উপরন্তু গেপ্তার হলে জামিন পেতে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আর এক শ্রেণির লোক মামলার তদ্বির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।

এই পর্যন্ত ডেভিল হান্টে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ২ হাজার লোক। জানা হয়নি সকলেই আওয়ামী লীগ কর্মী সমর্থক কিনা? তাছাড়া সরকার থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের এবং অন্য যারা গ্রেপ্তার হচ্ছে তাদের ‘ডেভিল’ বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। এক শ্রেণির আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা তৎকালীন যেমন বেনিফিশিয়ারী নয়। তেমনই এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েও কি রক্ষা হচ্ছে? বোধ করি অনেকটাই অনাকাঙ্খিত এই ঝড় তৃণমূলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকা কর্মীদের জন্য ‘অশনিঝড়’।

এ দিকে সরকার থেকেও ঘোষণা করা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। এতেও কেউ কেউ সন্দিহান। কারণও অনেকটা স্পষ্ট। রাজনীতিকদের দ্বিচারিতা। তাদের একেক সময় একেক ধরনের বয়ান। কখনো সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া। আবার কখনো প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবী জোরালো করা। আবার যাদের ভোটের মাঠে অতিশয় দূর্বল বলে ভাবা হচ্ছে তারাই আবার প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা দিতেও শুরু করেছে। অন্যদিকে ভোটের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত বড় দল বিএনপি ভোটের বিকল্প কিছুই ভাবছে না। তাদের দাবী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন। আবার নেতাদের একেক কথাও পরিষ্কার যথাসময়ে ভোট অনুষ্ঠান হওয়া নিয়ে।

এদিকে ভোটের মাঠে যোগ বিয়োগ গুন ভাগের যে সমীকরণ এতে করে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের আরেকটি কমিটি, জাতীয় নাগরিক কমিটিও রাজনৈতিক দল গঠন তথা আত্মপ্রকাশ নিয়ে ঘোষণা দিতেই যদিও বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে তথাপিও সতর্ক উচ্চারণে বলেছে সরকারে থেকে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করলে জনগণ ভালোভাবে নিবে না। মূলতঃ জনগণের দোহাই দিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেছে দলটি। যদিও অভ্যুত্থান পরবর্তী তারা যথেষ্ট চাঙ্গা থাকলেও এখন এই ঘোরচক্র সময়ে কিছুটা হলেও আতিশয্যে ভাটা পড়তে শুরু করেছে।

আবার জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের জোট গঠন করে চমকে দিতে চাইলেও কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা নিয়েও বোদ্ধামহল তথা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও যথেষ্ট সন্দিহান। আবার ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, এবি পার্টিসহ আরো কিছু দল মূলতঃ জামায়াতের বি টীম হয়েই মাঠে রয়েছে। আর যদি ছাত্রদের দল জামায়াতের সাথে ভোটের জোট করে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সে অভিযোগ নেহাৎই উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই বলেও অনেকেই তেমনটা মনে করছেন।

সর্বোপরি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আহ্বান করা হচ্ছে মব থামাতে। চলছে অপারেশন ডেভিল হান্ট। চলছে গ্রেপ্তার। নির্বাচনী আয়োজন। তথাপিও রাষ্ট্রীয় যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও দেখতে হবে। কথায় আছে ছোটবেলায় পুকুরে ব্যাঙ দেখে বাচ্চাদের ঢিল ছোঁড়ার আনন্দে যেন ব্যাঙের পরিবারে বিষাদের ছায়া না নেমে আসে! ডেভিল বলা হোক আর সন্ত্রাসী বলা হোক নিরীহ লোক গ্রেপ্তার করে বাহবা না কুড়িয়ে সংখ্যা কম হোক তবু যথাযথ হোক। সেটাই কাম্য। আরো উদ্বেগ ভর করেছে দেশের সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন এবং খালাস ও খালাসের প্রক্রিয়ায়। তেমন দৃষ্টান্ত না হোক যা ভবিষ্যতে নিজের বিরুদ্ধে যায়!

লেখক: অ্যাডভোকেট, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।