সোহবাত খান: ‘শিল্পের জন্যেই শিল্প’ এ তত্ত্বে ‘তির্যক নাট্যগোষ্ঠী’ বিশ্বাসী নয়। তির্যক বিশ্বাস করে ‘জনগণের জন্যেই শিল্প’। তাই, তির্যক কমিটেড হয়েই শিল্প সাধনা করে। চুয়াত্তরের জন্ম লগ্নে তির্যকের শপথ ছিল নাটক চাই, নিয়মিত পাদ প্রদীপের সামনে এসে দাঁড়াতে চাই, অবক্ষয় হতাশা থেকে মুক্তি চাই, নাট্যকার ও নাট্যকর্মী সৃষ্টি করতে চাই, প্রগতিশীল নাটক মঞ্চস্থ করতে চাই, নাটকের দর্শক সৃষ্টি করতে চাই। এখনো তির্যক এ প্রতিজ্ঞা পালনে যত্নবান। নানা বিধি নিষেধ, সংকট ও প্রচন্ড নৈরাশ্য বার বার চলার পথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, তারা থামেনি।
১৯৭৪ সালে যাত্রা শুরু করে আজ পর্যন্ত তির্যক নাট্যগোষ্ঠী ৩৬টি নাটকের সহস্রাধিক মঞ্চায়ন সম্পন্ন করেছে। নাট্যকার সৃষ্টির অঙ্গীকারে তির্যক প্রযোজিত ৩৬টি নাটকের মধ্যে ১৭টি নাটকই দলের নিজস্ব নাট্যকার রবিউল আলম, আলী আনোয়ার মোল্লা, আবু নাসের ফেরদৌস, রফিউল কাদের রুবেল ও ইরশাদ উল্লাহ সাঈদ হিরোর মৌলিক, অনুদিত ও গল্পের নাট্যরূপ। নাট্য প্রযোজনায় বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী বলেই তির্যক নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় নাট্যকার ছাড়াও দেশ বিদেশের নন্দিত নাট্যকারের নাটককে প্রাধান্য দিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রযোজিত নাটকের নাট্যকার হাসনাত আবদুল হাই, আবু রুশদ, মিখাইল শ্চেদ্রিন, মুনীর চৌধুরী, কাজী জাকির হাসান, সেলিম আল দীন, বার্টোল্ট ব্রেখট, বাদল সরকার, আন্তন চেখভ, সফদর হাশমী, ওলে সোইঙ্কা, সাইদ মাহমুদ, উইলিয়াম শেকসপীয়ার, শেখর সমাদ্দার, দারিয়ো ফো, অসীম দাশ।
সত্তর দশকে তির্যকের তথা চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটারের প্রথম ২৫তম প্রদর্শনী সম্পন্ন করা মঞ্চ নাটক সমাপ্তি অন্যরকম (’৭৫)। ১৯৮২ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান করে তির্যক। চট্টগ্রাম শিল্প ও সাহিত্য পরিষদ ৫-১১ ফেব্রুয়ারি ‘৭৭ সপ্তাহব্যাপী সাহিত্য-সঙ্গীত-নাট্য উৎসব করে পরিষদের খোলা মাঠে। উৎসবের শেষ পাঁচ দিনে পাঁচটি দল এখানে নাটক পরিবেশন করে। এটিকে তাই চট্টগ্রামের প্রথম গ্রুপ থিয়েটার উৎসবও বলা যায়। এতে তির্যক পরিবেশন করে দুটি নাটক জননীর মৃত্যু চাই (’৭৪) ও সিসিফিাসের একদিন (’৭৬)। দ্বিতীয়টির রচয়িতা হাসনাত আবদুল হাই। এ উৎসব ও পরবর্তী এখানে মঞ্চ নির্মাণে চট্টগ্রামের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই বিশেষ অবদান রাখেন। তির্যকের প্রথম ঢাকা সফর ছিল ’৭৯ সালে। ২২ জুন ’৭৯ বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ মঞ্চে দুটি নাটক ‘জননীর মৃত্যু চাই’ (’৭৪) ও ‘এক যে ছিল দুই হুজুর’ (’৭৭) পরিবেশন করে তির্যক। জামিল আহমেদ নির্দেশিত তির্যক নাট্যগোষ্ঠীর আলোচিত নাটক ‘আততায়ী’র (’৮৩) মাধ্যমে চট্টগ্রামের নাট্য আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক সরাসরি মঞ্চনাটক সম্প্রচার অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিন ১৩ জুলাই ’৮৪ এ নাটকটি সম্প্রচারিত হয় এবং ১৯৯৭ সালে ফের নতুন করে মঞ্চ নাটক সম্প্রচারের অনুষ্ঠান শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম নাট্যদল হিসাবে তির্যক নাট্যগোষ্ঠীর রবিউল আলম রচিত ও খালেদ হেলাল নির্দেশিত নাটক ‘বিপক্ষে বন্দুক’ (’৯৬) প্রচারিত হয় ১৯৯৭ এর ২৪ অক্টোবর। জামিল আহমেদ নির্দেশিত তির্যকের অন্যান্য নাটক হল- সমাধান (’৮৫), ভোমা (’৮৭), সহজ সরল পথ (’৯০)।
’৯২ এ রবিউল আলমের অনুবাদ ও নির্দেশনায় শেকসপীয়ারের ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ মঞ্চায়ন করে তির্যক। তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) নাট্যকলার শিক্ষক কামাল উদ্দিন নীলু নাটকটির সেট, লাইট, পোশাকের ডিজাইন করেন। চট্টগ্রামে উদ্বোধনী মঞ্চায়ন করেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আয়োজিত জাতীয় নাট্য উৎসব ’৯২-তে তির্যক নাটকটি পরিবেশনের করে ও বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা কর্তৃক শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার মতামত লাভ করে। সালাউদ্দীন ভুইয়া নির্দেশিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে নির্মিত নাটক ‘তীর্থযাত্রা’ (’৯৭) দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে ও প্রশংসিত হয়েছে। তির্যক সদস্যদের সহযোগিতায় রফিউল কাদের রুবেলের লিখা ও সাঈদ হিরোর নির্দেশনায় চলমান ঘটনাবলী নিয়ে নির্মিত ইম্প্রেভাইজ প্রযোজনা ‘সত্তান্ধ’ (২০০২) চট্টগ্রামের মঞ্চে নতুন সম্ভাবনার আলো দেখিয়েছে। অসীম দাশ নির্দেশিত নোবেলজয়ী নাট্যকার দারিওফোর ‘স্বপ্নবৎ’ (’৯৯) ও শেক্সপিয়রের ‘রোমিও জুলিয়েট’ (২০১৯) তির্যকের অন্যতম প্রযোজনা।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের শিল্প শষ্য গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য তির্যক ১৯৯১ সালে প্রযোজনা করে মুক্ত নাটক ‘সোয়াত জাহাজ’৭১”, ২০০৭ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে রফিউল কাদেরের রচনায় নাসির উদ্দীন খান নির্মান করে পথ নাটক ‘লজ্জা’, শামীম হাসানের নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দৃশ্যকাব্য ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’ (২০১১) দর্শককে মুগ্ধ করেছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্য উৎসব’ এ তির্যক এ প্রযোজনাটি পরিবেশন করে ও প্রশংসিত হয়।
শিশু-কিশোরদের নাটকের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াসে ১৯৭৭ সালে ‘তির্যক লিটল থিয়েটার’ নামে চট্টগ্রামে প্রথম শিশু নাট্য কার্যক্রম শুরু করে। তির্যক লিটল থিয়েটার নামে ক্ষুদেদের দলটি খালেদা ফেরদৌসের নির্দেশনায় ও আবু নাসের ফেরদৌসের রচনায় তিনটি কিশোর নাটক: কাঠের ঘোড়া ও আলীবাবা (মে ‘৭৭) ও শাহাজাদীর ঘুম ভাঙল না (ফেব্রুয়ারির ‘৭৮) ১১টি সফল মঞ্চায়ন হয়।
চট্টগ্রামের নাট্য চর্চাকে আরো বেগবান করতে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে নাট্য উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। চট্টগ্রামের নাট্যকর্মী ও দর্শকের কাছে উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন সময় আমন্ত্রণ করেছে দেশ বিদেশের উল্লেখযোগ্য নাট্যদলের সফল প্রযোজনা। ১০ ও ১১ জুন ‘৭৮ তির্যক-নাগরিক যৌথ আয়োজনে মুসলিম হলে নাগরিক পরিবেশন করে দেওয়ান গাজীর কিসসা ও বিদগ্ধ রমনীকূল আর তির্যক করে এক যে ছিল দুই হুজুর। ১৯৮৯ সালের ৩০ ও ৩১ জানুয়ারী শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চে পশ্চিম বঙ্গের অন্য থিয়েটার বিভাষ চক্রবর্তী নির্দেশিত নাটক ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ পরিবেশন করে। ১৯৯০ সালের ১ ও ২ ফেব্রুয়ারী দিল্লীর ‘নয়া থিয়েটার’ লোকজ নাটকের সফল নির্মাতা হাবিব তানভীরের নাটক ‘চরণ দাশ চোর’ ও ‘আগ্রাবাজার’ প্রদর্শন করে মুসলিম হলের মঞ্চে। বিশ্ব নাট্য জগতের কালজয়ী নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের ৯২তম জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে তির্যকের আয়োজনে ৮-১০ ফেব্র“য়ারী ’৯০ চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম ব্রেখট উৎসব। এতে ব্রেখটের নাটক সৎ মানুষের খোঁজজে, ধূর্ত উই ও সমাধান পরিবেশন করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা থিয়েটার ও তির্যক নাট্যগোষ্ঠী। এতে নাট্যজন জামিল আহমেদকে সম্মাননা দেয়া হয়। এছাড়াও, ছিল প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা। ১৪০০ সাল বরন ও ১৯ বছর পূর্তিতে ২৭ সেপ্টেম্বর-০১ অক্টোবর ’৯৩ পর্যন্ত পাঁচ দিন ব্যাপী নাট্যোৎসবের আয়োজন করে। ১৬-২১ মে ২০১৪ পর্যন্ত চার দশক পূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেতিতে ছয় দিন ব্যাপী নাট্য উৎসব আয়োজন করা হয়। এতে তির্যকসহ চট্টগ্রামের পাঁচটি ও ঢাকার একটি (লোক নাট্যদল-সিদ্ধেশ্বরী) নাট্যদল নাটক পরিবেশন করে। লকডাউনের মধ্যে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সদস্যদের অনলাইনের মাধ্যমে যুক্ত করে তির্যক নাট্যগোষ্ঠীর ৪৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করা হয়।
দক্ষ নাট্যকর্মী সৃষ্টির প্রচেষ্টায় বিগত বছরগুলোতে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী নাট্য কর্মশালা, সেমিনার ও আলোচনা সভা করেছে। বাংলা নাটকের ঐতিহ্য অনুসন্ধানে ২৫-২৭ মে ১৯৮৯ আয়োজিত ‘বাংলা নাটকে লোক আঙ্গিকের প্রয়োগ ভাবনা’ ও ‘লোক সংস্কৃতি ও নাট্য আঙ্গিক’ শীর্ষক সেমিনার ও আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের অরুন মুখোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের সাজেদুল আউয়াল। নাট্যকর্মীদের রাজনীতি সচেতন করার লক্ষ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর’ ৯৩ চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চে আয়োজিত হয় ‘বাংলা নাটকে রাজনীতি’ শীর্ষক একটি সেমিনার। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন নাট্যজন শান্তনু কায়সার এবং ২৯ সেপ্টেম্বর ‘৯৩ উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত স্মরণে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৬ সালে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক রবিউল আলমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের প্রথম (দেশের দ্বিতীয়) নাট্য ত্রৈমাসিক তির্যক। যা ছিল একটি প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। তিন বছরে পত্রিকাটির ১২টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, যেখানে পত্রস্থ হয় ৩০টি নাটক। তির্যকে প্রকাশিত নিবন্ধ ও নাটকগুলি সেই সময় সারা দেশের গ্রুপ থিয়েটারের প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করেছিল।
করোনাকালে লকডাউনের কারণে জনজীবনে স্থবিরতার মধ্যে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী অনলাইনে ‘করোনাকালে থিয়েটার’ শীর্ষক অনলাইন কথামালার আয়োজন করে। এতে দেশ বিদেশের নাট্য ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহনে ১৬ পর্ব সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এ কথামালার আলোকে করোনাকালে থিয়েটার কর্মীরা বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকান্ড আযোজন করে; যা থিয়েটার অঙ্গণে গতিশীলতা আনতে ভূমিকা পালন করে।
তির্যক নাট্য গোষ্ঠী চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে তথা ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, মাইজদী, চাঁদপুর, কক্সবাজারে নাটক প্রদর্শন করে দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে ও প্রশংসিত হয়েছে।
তির্যকের প্রত্যাশার পূর্ণতা এখনো অনেক দূরে। পথ চলায় তাই আজো বিরাম নেই। দর্শকের শুভাশীষ তির্যকের চলার পথের পাথেয়। দেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়কাল থেকে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী সহৃদয় দর্শকের শুভাশিষ নিয়ে আজো নাটকের মুকুরে স্বরূপ দর্শনে নিষ্ঠাবান।