চট্টগ্রাম: ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশে এলাকাভিত্তিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যুগোপযুগী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এর জন্য রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজ- সবাইকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীকে নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখার জন্য দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। মোবাইলের সহজলভ্যতার কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে বিপথগামী না হয়, সেই ক্ষেত্রে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতা প্রয়োজন। মেয়েরা শিক্ষা ও চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেন বৈষম্যের শিকার না হয়, তার উপর গুরুত্বারোপ করা দরকার। বাল্যবিবাহ ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সামাজিক আচরণ ও পরিবর্তনের জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহের সামগ্রিক হার কমানোর জন্য মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও কম বয়সে বিয়ে রোধ করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেয়া দরকার। বাল্যবিবাহ বন্ধে আইনের সঠিক চর্চা, প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরী। পাশাপাশি সরকারের নারীবান্ধব উদ্যোগগুলোর প্রচারে জোর দেয়া দরকার। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার, এনজিও, সিভিল সোসাইটি সংগঠন, পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরগুলোর মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।’
শনিবার (৩ জুন) ঘাসফুল আয়োজিত ‘বাল্যবিবাহ: লিঙ্গ সমতার অন্তরায়’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ঘাসফুলের চেয়ারম্যান ও সমাজবিজ্ঞানী ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ এবং পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। স্বাগত বক্তব্য দেন ঘাসফুলের সহকারী পরিচালক সাদিয়া রহমান। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার। প্যানেল আলোচক ছিলেন বেগম রোকেয়া পদক ও একুশে পদক প্রাপ্ত শিক্ষাবিদ এবং খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারপার্সন প্রফেসর ড. মাহফুজা খানম, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন, সাবেক সাংসদ ও জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়ব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলা উদ্দিন ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) সাবেক অধ্যক্ষ ও চবির মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির ডীন প্রফেসর ডাক্তার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
ওয়েবিনারে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘আমাদের সংস্থা পিকেএসএফ সহযোগী সংস্থাদের উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে যুব সমাজ ও কিশোরী ক্লাবগুলো বাল্যবিবাহ, মেয়েদের উত্যক্তকরণ ও নারী নির্যাতন রোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। আইন সর্ম্পকে আমার একটি কথা আছে, যখন ১৮ বছর করা হচ্ছিল ও ১৬ বছরের প্রবিশন রাখা হচ্ছিল, তখন একটি যুক্তি দেয়া হত, বিশ্বের অন্যান্য দেশে আছে যেমন ইউকেতে আছে। কিন্তু, ইউকেতে আছে, তা কিন্তু বিবাহ দেয়ার জন্য না বিবাহ রোধ করার জন্য। ওখানে মেয়েদের বিবাহের গড় বয়স ২০ বছর আর আমাদের দেশে ১৫-১৬ ইত্যদি। কাজেই ওই যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানে সুযোগটা অনেক নিচে। এ সুযোগটা অনেকে নিচ্ছে। সুতরাং, সর্তকভাবে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে; যাতে কেউ সুযোগটা নিতে না পারে। একজন মেয়ে যদি বিপদে পরে, তাকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু, কেউ যেন সে সুযোগটা না নিতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘করোনাকালে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বলা হয়েছে, এখানে কিন্ত যাদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদেরকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা কঠিন। একটা কারণ, হচ্ছে বিয়ে হয়ে গেলে উপবৃত্তি দেয়া হয় না অনেক সময় ফিরে আসলেও। এদেরকে ফিরিয়ে আনার একটা প্রচেষ্টা থাকা দরকার। তাদেরকে সহায়তা দিয়ে যদি আনা না হয়, তাহলে তো তাদের ভবিষ্যতে আমরা মনে করি, মানুষকে এগিয়ে যেতে হলে নারী-পুরুষ কোন বিষয় না উভয়ের এগিয়ে যেতে হলে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ হয়ে গেলে এ তিনটা বিষয় থেকে ছিটকে পড়ে। সক্ষমতা বাড়ানো থেকে যদি ছিটকে পড়ে, তাহলে তাদের ভবিষ্যত নষ্ট হল ও সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছেলে মেয়েদেরও ভবিষ্যতে সমস্যা হয়। সক্ষমতারভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। মূল কথা হচ্ছে, মানুষ হিসেবে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই সমান। নারী-পুরুষ নাই। সেই ধারণাটা যদি আমরা গ্রহণ করি, বহু বছর ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিকতা, সেটা রোধ করতে হলে – সেই ধারণাটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে মানুষ সব সমান। কে কি কাজ করবে নিজে সিদ্ধান্ত নিবে, মানুষ হিসেবে তার যে অধিকার পাওনা, মর্যাদা পাওয়া তা সকলের প্রাপ্য।’
মনজুর উল আমিন চৌধুরী বলেন, ‘ইউএনএফপির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাল্যবিবাহে বাংলাদেশ এশিয়ার শীর্ষে, ১৮ বছর বয়সের আগে ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। অথচ মালদ্বীপে দুই শতাংশ, শ্রীলংকায় দশ শতাংশ, পাকিস্থানে ১৮ শতাংশ, ভারতে ২৩ শতাংশ, ভূটানে ২৬ শতাংশ, আফগানিস্থানে ২৮ শতাংশ ও নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইউনিসেফের সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায়, বর্তমান ধারায় এ অঞ্চলে বাল্যবিবাহের পুরোপুরি অবসান হতে প্রায় ৫৫ বছর লাগতে পারে।’
করোনা পরবর্তী চট্টগ্রাম শহরের সড়ক পরিবহণে যুক্ত শিশুদের উপর তার সাম্প্রতিক গবেষণার বরাতে মনজুর উল আমিন জানান, ৩৩৮ জন উত্তরদাতার মধ্যে ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ ছেলেশিশুও বাল্যবিবাহ করেছে, যা উদ্বেগের। মেয়েশিশুদের পাশাপাশি ছেলেশিশুদের মাঝেও বাল্যবিবাহের ঝোঁক বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক। আমাদের সচেষ্ট হতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে।’
উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য দেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ পরিচালক মাধবী বড়ুয়া, সরকারী হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহাম্মদ কামরুল ইসলাম, পটিয়া লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জীব কুসুম চৌধুরী, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পশ্চিম শিলক বেদৌরা আলম চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুবিনা ইয়াসমিন, ডাক্তার খাস্তগীর সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ফাহমী নাহিদা নাজনীন, ইপসার ফারহানা ইদ্রিস, ব্র্যাইট বাংলাদেশ ফোরামের নির্বাহী পরিচালক উৎপল বডুয়া, সংশপ্তকের নির্বাহী পরিচালক লিটন চৌধুরী, স্বপ্নীল ব্র্যাইট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. আলী শিকদার, অপরাজেয় বাংলাদেশের মাহবুব উল আলম ও মায়মুনা আক্তার মিম (ভুক্তভোগী বাল্যবিবাহ)। ওয়েবিনারে আটটি সুপারিশমালা গৃহীত হয়।
অনুষ্ঠানে অংশ নেন সৌদিআরব থেকে (হজ্জপালনরত) ঘাসফুলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আফতাবুর রহমান জাফরী, ঘাসফুলের সাধারণ পরিষদের সদস্য শাহানা মুহিত, ঝুমা রহমান, জেলা তথ্য অফিস চট্টগ্রামের উপ পরিচালক সাঈদ হাসান, যুগান্তর সমাজ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইয়াছমিন পারভীন, ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়ক এনামুল হাসান, আইডিএফের সুদর্শন বডুয়া, মনিষার নির্বাহী পরিচালক আজমল হোসাইন হিরু, উপকুল সমাজ উন্নয়ন সংস্থার জোবায়ের ফারুক লিটন, প্রত্যাশির সুফি বশির আহমদ মনি, উষার পিযুষ দাশ গুপ্ত, ঘাসফুল পরাণ রহমান স্কুলের অধ্যক্ষ মাহমুদা আক্তার।
ওয়েবিনারটি ঘাসফুল ফেসবুক থেকে লাইভ সম্প্রচার করা হয়।