গাজী তারেক আজিজ: আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার আগে চলচ্চিত্র কিংবা নাটকে আদালত সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম। সেটা জাস্ট আদালতের কাঠামোগত দিক ছিল। যেখানে দুই পক্ষের জাঁদরেল অ্যাডভোকেট মামলায় লড়ে মক্কেলকে বিজয়ী করছেন। অর্ডার অর্ডার, অবজেকশন, মাই লর্ড, অবজেকশন সাসটেইনে, অবজেকশন ওভার রুল, বিজ্ঞ বন্ধু, বাদী, আসামী, প্রতিপক্ষ। এসব শব্দগুলো আদালত অঙ্গনে বেশ সুপরিচিত। গাউন পরিহিত বিজ্ঞ বিচারক এজলাস পরিচালনা করছেন, আর জনাকীর্ণ আদালতে উভয় পক্ষের বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটও গাউন পরিহিত। আদালতের আঙিনায় কিংবা বারান্দায় গেলে সে এক ভিন্ন আমেজ কাজ করে।
আইন পেশায় আসার আগে ফেনী জেলায় আদালত ভবন ছিল রাজাঝি দীঘির পাড়ে। মাঝেমধ্যে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে সেই এজলাস দেখতাম। মনের মধ্যে ভয় কাজ করতো খুব! কেউ দেখলে বাঁধা দেয় কিনা! আদালতের পাশেই ছিল মানুষজনকে পুঁথি পাঠ করে শোনাতো। তা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। ভালো লাগতো, তবে কিছুই বুঝে উঠতে পারতাম না। আর ছিল হকারের আনাগোনা। কালের বিবর্তন ঘটতে শুরু করলে সেই আদালত ভবন শহরের সন্নিকটে বারাহীপুরে স্থানান্তরিত হয়। নিজেও আইন পড়া শেষ করে যখন শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিলাম, তখন থেকে চলচ্চিত্রের সেই আদালতের এজলাস এবং অধিবেশন সবকিছুতেই বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করলাম। পরে যখন নিজের সনদ হলো তখন ধীরেধীরে শুনানিতে অংশ নেয়া শুরু হলো। আর মাঝেমধ্যে বইয়ের পাঠের সাথে বাস্তবিক আদালতের অনেক অমিল খুঁজে পেতে শুরু করলাম। নিজে নিজে মনে উদ্রেক করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলাম। কখনো পেলাম, কখনো পেলাম না।
তার কিছু দিন পরের সময়ে একটি চাঞ্চল্যকর মামলায় বিচার শুরু হলে প্রায়শঃই জেলার সর্বোচ্চ আদালত দায়রা আদালতে যেয়ে অধিবেশন পর্যবেক্ষণ করতাম। তখন প্রায়শঃই দেখতাম চেনাজানা অনেক সাংবাদিক এসে আদালতের পিছন দিকে বসে বিচার-প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করতেন। তার পরের দিন পত্রিকার পাতায় অধিবেশনের সেই খবরাখবর ফলাও করে ছাপা হতো। নিজের দেখার সাথে সাংবাদিকদের বর্ণনা আর দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে নতুন করে ভাবতাম। নিজেকে আরো বেশিমাত্রায় ঋদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা কখনো দমিয়ে রাখিনি আজ অবধি!
আইন পড়াকালীন আমাদের শংকর সাহা স্যার আদালত সম্পর্কে কিছু ধারণা দিয়েছিলেন। যেমন- কোন অ্যাডভোকেটকে ভাই বলে সম্বোধন না করে সাহেব বলে সম্বোধন করা। পেশায় নিয়োজিত অপরাপর সবাইকে ‘লার্নেড’ বলে সম্বোধন করা। আর পেশায় এসে দেখি ঠিক উল্টো চিত্র! পেশায় নিয়োজিত পেশাগত সিনিয়রদের ‘সিনিয়র’ এবং জুনিয়রদের নাম ধরে ভাই বলার রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। অঞ্চলভেদে বিজ্ঞ সিনিয়র সদস্যদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। ক্লাসে শিখেছিলাম আদালতকে বিজ্ঞ আদালত অথবা মাননীয় আদালত অথবা ইওর অনার বলতে। আদতে প্রচলন হচ্ছে, স্যার! এতে আদালতও কিছু মনে করেন না। আবার আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মক্কেলকে উদ্দেশ্য করে কখনো কখনো বলেন, আপনার উকিলকে ডেকে নিয়ে আসেন। অথচ আইনে উকিল বলতে কিছুই নেই। অধিকন্তু এটাও প্রচলন ঘটে গেল।
আজকে আমাদের মূল আলোচনার বিষয়ে আসা যাক, চলচ্চিত্রের কিংবা নাটকের সেই আদালত অধিবেশন চলাকালীন যা বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্য করতে কিছু চটকদারত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে। বাস্তবে তা তেমন না হলেও অনেকাংশে মিল খুঁজে পাওয়া যায় কিংবা মিল খুঁজে নেয়া হয় অথবা মিল খোঁজার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তাই, যারা প্রথম আদালতে আসেন, তারা পর্দায় দেখা সেই কল্পিত আদালত মনে পোক্ত করে রাখেন বলেই আদালতে এসে কিছুটা হলেও খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। তবে সেটা সবসময়ের জন্য নয়। কয়েক দিন এলেই সে ভুল ভেঙে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে বেশি সময় লাগে না। তেমনই একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল ২০১১-১২ সালের দিকে। এলএলবি কোর্সে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রী আদালতের অধিবেশন দেখতে এলেন। এসেই বাচবিচার না করেই কক্ষে ঢুকে বসে গেলেন চেয়ারে। এদিকে অধিবেশন শুরু। আর বিচারপ্রার্থী লোকজন আর অ্যাডভোকেট এবং তাদের সহকারীদের মামলার তদ্বির মিলিয়ে কিছুটা সরগরম অবস্থা। তো তখনই সেই ছাত্রী বলে উঠলো, এখানে কি সবাই কথা বলার জন্য আসে? তখন আমাদের এক কলিগ অ্যাডভোকেট সাইফুল্ল্যাহ রাসেল হেসে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ এখানে সবাই কথা বলার জন্যই আসে। পড়ালেখা বাড়িতে করে!’ সেই আইনের ছাত্রীটি বার কাউন্সিল সনদ নিয়ে ঠিকই এলেন। তবে পেশায় থিতু হলেন না।
এবার আসা যাক মূল কথায়। ক্লাসে শিক্ষক পড়িয়েছিলেন, আদালত অধিবেশন চলাকালীন মোবাইল রিংটোন বেজে উঠলে বিচারকের কাজে বিঘ্ন ঘটলে আদালত অবমাননা মনে করলে পরিস্থিতি হবে বিব্রতকর। তাই অধিবেশন চলাকালীন ফোনের রিংটোন মিউট করে ভাইব্রেশন মুডে রাখতে হবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন! অধিবেশন চলাকালীন অনেক মক্কেল কিংবা বিজ্ঞ আইনজীবীর কিংবা সহকারীদের মোবাইলে রিংটোন বিকট শব্দে বেজে ওঠে। যাতে বিচারক কিংবা অপরাপর আইনজীবী যারা শুনানিতে থাকেন তাদের সকলেরই কাজে ব্যাঘাত ঘটে। যদিও এখনকার সময়ে এসে প্রযুক্তিতে অনেকটুকু এগিয়ে থাকা জেনারেশন সে কাজটি সচেতনভাবেই করেন না।
আবার অনেক সময় দেখা যায়, আদালতের অধিবেশন চলাকালীন অনেক বিচারপ্রার্থী কিংবা সাথে থাকা দর্শনার্থীদের কেউ কেউ অধিবেশন কার্যক্রমের ভিডিও গোপনে ধারণ করে পরে প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করে থাকেন। তাহলে একটা বিষয় সামনে এসে যায় আদালতের কার্যক্রম কি ছবি তোলা কিংবা ভিডিও ধারণ, কিংবা প্রচারযোগ্য? এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন বিধিবিধান কোথাও উল্লেখ নেই। তথাপি কৌতুহল বশত এই কাজটি যে কেউ না কেউ করেন না বা করতে উৎসাহী নয়, তেমনটা নয়। তাহলে কি ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণ করা যাবে? তবে তা-ও নয়। যদি তা-ই হতো তাহলে অতীতে অহরহ তেমনটা দেখতে পাওয়া যেত। তা-ই বলে আদালতের বিচার-প্রক্রিয়া বা বিচার কাজ কি সংরক্ষিত কিছু? যদিও তা নয়। কিন্তু অতীতে আমাদের দেখা হয়েছে কখনো কেউ ভিডিও করলে তা আদালতের নজরে এলে, মোবাইল বা যে কোন ডিভাইস থেকে ডিলিট করে দেয়ার বিষয়টি। কিন্তু কার্যত আদালত এজলাস পাবলিক প্লেস হওয়ায় ভিডিও কিংবা ছবি তোলা যাবে না, তা একবাক্যে বলে দেয়া যায় না। কিন্তু এ বিষয়ে একটি মামলার রেফারেন্স হিসেবে দেয়া যেতে পারে। তা হল- দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় গত ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রচার হয়। যাতে শিরোনাম করা হয়, ‘আদালতের বিচার কার্যক্রমের ভিডিও ধারণ করায় একজনের দন্ড’
ওেই প্রতিবেদনের বিবরণ থেকে হানা যায়, মৌলভীবাজারে বিচারকাজ চলাকালে মোবাইলে আদালতের কার্যক্রম ভিডিও করার সময় একজনকে আটক করা হয়। বিনা অনুমতিতে আদালতের কার্যক্রম ভিডিও করার দায়ে দুইশ টাকা অর্থদন্ড, অনাদায়ে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন বিচারক। মৌলভীবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, দ্বিতীয় আদালতে ৩ ডিসেম্বর এ ঘটনা ঘটে। দন্ডিত ব্যক্তির নাম মামুন আহমেদ, পিতা দিলুমিয়া, মাতা-পারুল বেগম, সাং- উত্তরখলগাঁও, দক্ষিণভাগ, ডাক-করিমপুর, থানা-রাজনগর, জেলা- মৌলভীবাজার।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, দুপুর ২টার দিকে মৌলভীবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, দ্বিতীয় আদালতে একটি মামলায় মেহেদী হাসান নামীয় একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ চলছিল। এ সময় তার ভাগিনা মামুন আহমেদ মোবাইলে আদালতের কার্যক্রম ভিডিও করতে দেখা যায়। বিষয়টি আদালতের সহায়ক কর্মচারী বিচারক এম মিজবাহ-উর-রহমানের নজরে বিচারক নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত পুলিশ সদস্যকে ওই ব্যক্তিকে আটক করার নির্দেশ দেন। আটককৃত ব্যক্তির হাতে থাকা রেডমি ব্রান্ডের মোবাইলে আদালতের কার্যক্রম ভিডিও করার সত্যতা প্রাপ্ত হন। পরে আটককৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে সে তার নাম ঠিকানা প্রকাশ করে। আটককৃত ব্যক্তি মামুন আহমেদের ওই কর্মকান্ডের কারণে বিচারিক কার্যক্রমের বাধা সৃষ্টি হওয়ায় এবং বিনা অনুমতিতে আদালতের কার্যক্রম মোবাইল ফোনে ভিডিও করায় আদালতের প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে অশ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে তার অপরাধ পেনাল কোড-১৮৬০’-এর ২২৮ ধারায় গণ্য করে ফৌজদারি কার্যবিধির, -১৮৯৮’-এর ৪৮০ ধারানুযায়ী ২০০ টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন।
উপরের প্রতিবেদন ও আইন বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে, যদি বিচারক মনে করেন, তবেই তেমন আদেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে ভিডিও ধারণ ব্যতিরেকে অন্য যে কোন বিষয়েও দেয়ার সুযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইনটিতে। তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে, ভিডিও ধারণ কিংবা ছবি তোলাই মূখ্য বিষয় না-ও থাকতে পারে।
এবার আসা যাক সংশ্লিষ্ট আইনটিতে কি ব্যাখ্যা দেয়া রয়েছে, দণ্ডবিধির ২২৮ ধারা অনুযায়ী বিচার বিভাগীয় কাজ পরিচালনায় আসীন সরকারী কর্মচারীকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান বা বাধা প্রদান করা কোন সরকারী কর্মচারী কোন বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের যেকোন পর্যায়ে নিয়ত থাকাকালে কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে অপমান করে বা তার কাজে বাধা প্রদান করে, তবে সে ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত যেকোন পরিমাণ অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।
মৌলভীবাজার জেলার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধিনস্ত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮০ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তকে ২০০ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে আদেশ দেন। তাহলে এবার আসা যাক, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮০ ধারায় কি বলা রয়েছে, বলা হয়েছে অবমাননার কিছু ক্ষেত্রে পদ্ধতি-
কোন দেওয়ানী, ফৌজদারী বা রাজস্ব আদালতের দৃষ্টি গোচরে বা উপস্থিতিতে দণ্ডবিধির ১৭৫, ১৭৮, ১৭৯, ১৮০ বা ২২৮ ধারায় বর্ণিত কোন অপরাধ করা হলে ওই আদালত অপরাধীকে হাজতে আটক রাখার ব্যবস্থা করতে পারবেন এবং ঐদিন আদালতের অধিবেশন শেষ হবার পূর্বে যে কোন সময় উপযুক্ত মনে করলে অপরাধটি আমলে নিতে পারবেন এবং অপরাধীকে অনধিক দুইশত টাকা অর্থদণ্ডে এবং যথাশীঘ্র জরিমানার টাকা প্রদান করা না হলে এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন। এই প্রসঙ্গে অল ইন্ডিয়া রিপোর্টে রুলিং থেকে জানা যায় যে, এই ধারার অধীনে মামলার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে না ৪৭৬ ধারার অধীনে মামলার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে তা বেছে নেয়া আদালতের ক্ষমতা রয়েছে (এআইআর ১৯৬৯ এএলএল ৬৯৩) এবং লক্ষ্য করার বিষয় এ যে, কেবলমাত্র সেসব অবমাননারই এই ধারায় বিচারের বিধান আছে যা আদালতের সামনে বা উপস্থিতিতেই সংঘটিত হয়।
যদিও অন্য রকম অবমাননার অপরাধ, আদালত অবমাননা আইন (১৯২৬ সনের ১২ নম্বর আইন) অনুসারে বিচার্য।
যদিও ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫২ ধারার বিধান মতে স্পষ্ট করা হয়েছে, আদালত উন্মুক্ত থাকবে- কোন অপরাধের তদন্ত বা বিচারের উদ্দেশ্যে যে স্থানে কোন ফৌজদারী আদালতের অধিবেশন সেই স্থানকে উন্মুক্ত আদালত বলে গণ্য করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে সুবিধাজনক স্থান সংকুলান হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে প্রবেশাধিকার থাকতে পারে সর্বসাধারণের৷ তবে শর্ত এই যে, প্রিসাইডিং জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট উপযুক্ত মনে করলে কোন বিশেষ মামলার অনুসন্ধান বা বিচারের যেকোন পর্যায়ে আদেশ দিতে পারবেন যে, সর্ব সাধারণ বা কোন বিশেষ ব্যক্তি আদালত কর্তৃক ব্যবহৃত কক্ষ বা ভবনে প্রবেশ করতে বা তথায় অবস্থান করতে পারবে না।
এ থেকে বোঝা যায় আদালত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা বলা হয়ে। কিছু বিষয়ে আদালতের বিচারক মনে করলে কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আদেশ দিতে পারেন, যিনি আদালত কক্ষে থাকা না থাকা বিষয়ে, তবে তা সার্বজনীন নয়।
এর ব্যতিক্রম হিসেবেও উচ্চ আদালতের কিছু রুলিং রয়েছে। যা নিম্নরূপ-
আদালত কর্তৃক জনসাধারণ এবং আইনজীবীদের (যারা মামলার সাথে জড়িত নয়) আদালত কক্ষে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ইহা কোন বাধা নয় (১৮ ডিএলআর ১৫৪ ডব্লিউপি); ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কক্ষ ছাড়া অন্যত্র বিচার কাজ সম্পন্ন করতে পারেন; তবে সেক্ষেত্রে বিচারের স্থানটিকে ঘোষণা দ্বারা একটি আনুষ্ঠানিক বিচারের স্থান বলে পূর্বাহ্নে চিহ্নিত করতে হবে। (২১ ডিএলআর ৩১০)
আমরা মিডিয়ার বরাতে জানতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার অভিযোগে আনীত মামলায় বিচারকাজ চলাকালীন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন। যদি সেদিক থেকেও ধরে নেই, তাহলে এটা স্পষ্ট হয় যে, আদালতের কার্যক্রম ভিডিও করা বে-আইনি তো নয়ই, কোথাও কোন আইন দ্বারা বারিত থাকারও কারণ নেই।
আরও একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আপীলেট ডিভিশনের এজলাসের অভ্যন্তরেও সিসি ক্যামেরা বসানো রয়েছে। এদিক থেকে ধরে নিলে বলা যায়, ভিডিও ধারণে বাধা নেই। তবে, সেই সিসিটিভি ক্যামেরা সম্প্রচারের জন্য নয়। উক্ত ক্যামেরা শুধু ভিডিও রেকর্ড করে ধারণ করে না। এই রেকর্ড একটা স্টোরেজে(ডিভিআর) এ সুনির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। এই ক্যামেরা সরাসরি কেউ অপারেট করে না। যদিও সারাদেশে আদালত অঙ্গনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপিত রয়েছে। দেশের অনেক নিম্ন আদালতেও সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে।
তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলিকাতা হাইকোর্ট এজলাসের অভ্যন্তরীণ ক্যামেরা থেকে অধিবেশন চলাকালীন ধারণ ও সম্প্রচার বিভিন্ন মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায়। তাহলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, প্রকাশ্য কিংবা গোপনে ভিডিও ধারণে বাধানিষেধ যেমন নেই, তেমনি ধারণ করার কথাও বলা হয়নি কোথাও।
পরিশেষে, একটা বিষয় হচ্ছে, বর্তমান এআইয়ের যুগে বিশ্ব যেমন এগিয়ে চলেছে, তেমনি বাংলাদেশও সমানতালে এগিয়ে যাবে আমিরা প্রত্যাশা করি। যেমন করোনা মহামারীর সময়কালে আইনে না থাকলেও দেখেছি প্রযুক্তির উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। যাতে জামিনসহ গুরুত্বপূর্ণ শুনানী যেমন হয়েছে, তেমনি রিমান্ড শুনানির মতো শুনানিও খাস কামরায় বসে বিচারক শুনেছেন, আইনজীবী চেম্বারে বসে শুনানি করেছেন আর আসামী জেলখানায় থেকে অংশ নিয়েছেন। সেটা যেমন করে সম্ভয় হয়েছে তেমনি করে, বিশেষ চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানি ডিসপ্লেতে দেখানোর ব্যবস্থা করা গেলে এর ক্ষতি নেই বরং মানুষ দেখে শিক্ষা নিতে পারে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, কলামিস্ট ও আইন গবেষক, ফেনী।