মাওলানা মুহাম্মদ নূরুল আবছার: সৌদি আরবের মক্কা শরীফ থেকে হুজুর কেবলা আল্লামা সৈয়দ শামসুল হুদার (রহ.) পূর্বপুরুষরা এতদঞ্চলে আগমন করেন। ইসলাম বিস্তারই ছিল তাদের আগমনের মূল উদ্দেশ্য। পিতৃভিটা ছেড়ে পার্থিব লোভ-স্বার্থ নিয়ে তারা এখানে আসেন নি। বাস্তবেও দেখা গিয়েছে যে, শিক্ষা, তরীকত ও দ্বীনের প্রচারই তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম করে গিয়েছেন।
খাঁটি আওলাদে রাসুল (দ.)। যুগের পর যুগ তাদের বসতবাড়ি সৈয়দ বাড়ি হিসেবে পরিচিত। তাদের প্রজন্ম থেকে অসংখ্য পীর-দরবেশ জন্ম নিয়েছেন। সব শ্রেণির মানুষ তাদেরকে সৈয়দ সাহেব হুজুর হিসাবে সম্বোধন করতেন। সকলে এ নামেই তাকে চিনতেন। এর আরো লক্ষণ হল-তিনি কখনো কাউকে কটু কথা বলতেন না। অমায়িক ব্যবহার, চরিত্রের মাধুর্য ও হেকমতের মাধ্যমে তিনি প্রত্যেকজন থেকে কাজ আদায় করতেন। তার সুমিষ্ট ব্যবহারেই অনেকে তার ভক্ত হয়ে যেত। হুজুর কেবলা চট্টগ্রাম ছোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ থাকাকালে সিনিয়র-জুনিয়ার কাউকে শোকজ করেন নি। অথচ তখন জাঁদরেল ওলামায়ে কেরাম তার অধীনে চাকরি করতেন। জামাতে ইসলামী চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা আমীর মাওলানা শামসুদ্দীন সাহেব, আগ্রাবাদের পীরখ্যাত মাওলানা সাইফুর রহমান নিজামী, পাক-ভারত উপমহাদেরশের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাওলানা ফুরকান (রহ.), মাওলানা নজীর আহমদ (রাহ.), উপমহাদেশের ইলমে মানতেকের উস্তাদখ্যাত মাওলানা সালেহ আহমদ (রাহ.), যুগের গায্যালী হিসেবে স্বীকৃত মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন (রাহ.), বিখ্যাত মুহাদ্দিস যিনি জীবনের অধিকাংশ সময় সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার হাদিস পড়িয়েছেন মাওলান ফখর উদ্দীন (রহ.), মুহাদ্দিস মাওলানা ছৈয়দ মুহাম্মদ আলী (রাহ.), মুহাদ্দিস মাওলানা ইউনুচ (রাহ.) ও শীতলপুরের পীরে তরিকত বহু গ্রন্থের রচয়িতা মাওলানা আলী আকবরসহ (রহঃ) অসংখ্য যুবশ্রেষ্ঠ মনীষী তার অধীনে চাকরি করেছেন।
ইমামে আহলে সুন্নাত গাযিয়ে দ্বীন মিল্লাম ইমাম আল্লামা সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রাহ.) ও বর্তমান ইমামে আহলে সুন্নাত পীরে তরিকত, শায়খুল মাশায়েখ কাযী মাওলানা নূরুল ইসলাম হাশেমী (মজিআ) তাকে সমীহ, সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন।
এসব শুধু তার চরিত্রের মাধুর্যতা, নৈতিকতার শ্রেষ্ঠত্বা ও ব্যবহারের হৃদয়হরীতার কারণেই হয়েছে। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর মাহবুবের দশ বছর খেদমত করেছি। কোন কাজের জন্যেই কখনোই তিনি আমাকে তিরস্কার করেন নি। প্রিয় রাসুলের চরিত্রের এ আবহ তার জীবনে প্রতিবিম্বিত হয়েছি। তার আমলে যে ছাত্ররা লেখাপড়া করেছিল, তাদের প্রায়ই দেশশ্রেষ্ঠ কীর্তিমান নাগরিক হয়েছেন। ব্যবসায়, রাজনীতি, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষা ও সমাজ কর্মে তাদের বিচরণ উল্লেখ করার মত। তার ছাত্রদের বহুজন শায়ৈখ তরীকত ও মুর্শিদে বরহক হিসাবে মূর্তিমান। অনেকে মুহাদ্দিস, ফকীহ, ওয়ায়েজ, শিক্ষক ও প্রশাসক হিসাবে কর্মরত আছেন।
ছোবহানিয়অ মাদ্রাসা প্রথমে হেফজখানা দিয়ে শুরু হয়। পরে দাখিল, আলিম স্তরে উন্নীত হয়। হুজুর কেবরঅ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সেটা ফাজিল ওকামিল স্তরে তরক্কী অর্জন করে। আর লেখাপড়ায়র মানে দিক দেয় শ্রেষ্ঠ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সনদ অর্জন করে। ছাত্র শিক্ষক কোন্দল, রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও স্থানীয়-অস্থানীয় নিয়ে এপ্রতিষ্ঠানে কখনো ঝগড়া-ঝাটি হয় নি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মহান আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত অত্র প্রতিষ্ঠানকে মূলধারার ওপর ধরে রাখার জন্যে তিনি খুব চেষ্টা করতেন। যার কারণে ভিন্ন আদর্শের কাউকে মাথাচড়া দেয়ার তিনি সুযোগ দিতেন না। ফলে বরাবরই এখানে শান্তি-শৃংখলা বজায় ছিল। তার শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্লাস নিতেন। এটা দ্বারা তার ইলমী পারদর্শিতার প্রমাণ মেলে। সর্বোচ্চ ক্লাসের সর্ব কঠিন উসুলে হাদীসের গ্রন্থ ‘নুখবাতুল ফিকর’ উসুলে তাফসীরের ‘আল্ আত্কান ফি ই’জাযিল কুরআন; ফাজিল শ্রেণিতে ‘মুখতাসারুল মা’নীর’ ন্যায় জটিল কিতাবগুলো তিনি পড়াতেন। তার পাঠদান পদ্ধতি ছিল সহজবোধ্য। তার পড়ানোতে রস থাকত। ফলে ছাত্ররা সহজে ও অনায়াসে বুঝে ফেলতেন।
দীর্ঘ দেহী, চমৎকার সুন্দর ও উজ্জ্বল ত্বকের অধিকারী এ মনীসীর মুখাবয়বে ব্যক্তিত্বের আভা পরিস্ফুটিত ছিল। চলনে, বলনে, কহনে মাত্রাতিরিক্ত কিছু প্রদর্শন করতেন না। সব ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিকতা ও মধ্যমপন্থাকে গ্রহণ করতেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নীতি নির্ধারণী সভাগুলোতে তিনি মধ্যমনির ভূমিকায় থাকতেন। সব দুঃসময়ে তিনি কান্ডারীর ভূমিকা পালন করতেন। রাজনৈতিক, সামাজিক, ও তরিকত ভিত্তিক সব সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তার অবদান উল্লেখ করার মত। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার অবদান উল্লেখ করার মত।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। বি-বাড়ীয়ায় তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলো দ্বীনি শিক্ষা প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। বোয়ালখালীর শাকপুরার মাদ্রাসা এখনো কুরআন-হাদীসের পাঠ দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খানকাহ তার মাদ্রাসা ও মসজিদ বিদ্যমান। রাঙ্গুনিযঅর মাদ্রাসা ও খানকাহ বর্তমানে সে অঞ্চলকে আবাদ করে রেখেছে। তার পূর্বপুরুষদের প্রবর্তিত তরীকার অনুসারী মানুষের সংখ্যা অগণিত। তার ইন্তেকালের পর তার সন্তান পীরে তরিকত, মুর্শেদে বরহক সায়য়্যিদ মাওলানা মুহাম্মদ মছিহুদ্দৌলা (মা জি আ) একমাত্র সাজ্জাদানশীন হিসেবে উক্ত তরিকত ও প্রতিষ্ঠানগুলোর খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রতিটি কর্মসূচিতে তার অংশগ্রহণ ও উদারহস্তের দান সর্বপ্রিয়। তিনি জাতীয় পর্যায়ে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন পরিষদের মহাসচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। সব বিতর্কের উর্ধ্বে অবস্থান করে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহান দিকপাল হসিাবে তার দায়িত্ব পালন সত্যিই প্রশংসনীয়। শতব্যস্ততার মাঝেও সুন্নিয়তের যে কোন ডাকে সাড়া দিতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না। পিতার আদর্শ অনুসরণ করে ও তার স্মৃতিকে ধারণ করে তার পথ চলা তরিকত ও সুন্নিয়তকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্যে তিনি ইতিমধ্যে দরছে নেজামীর আদলে স্বকীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। শ্রেষ্ঠ আলেম-ওলামার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থবহ দ্বীনি শিক্ষার জন্যে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করছেন। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার সাথে সমন্বয় করে কুরআন হাদিসের শিক্ষার জন্য তিনি আলাদা সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রবর্তন করেছেন। তার স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন বক্তব্য হল- আলেম এমন হতে হবে, যিনি কুরআন হাদিস আরবীতে পড়ে বুঝতে পারেন। অন্যকে বুজাতে পারেন ও যথাযথ বিশ্লেষণ করতে পারেন। সৃজনশীল প্রতিবা না থাকলে শুধু গৎবাঁধা শিক্ষা নিয়ে আলেম হওয়া যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগে নিত্য নতুন হরেক রকমের সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। প্রকৃত আলেমকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে এসবের সমাধান দিতে হবে। এ জন্যে তার নাহু-সরফ, বলাগত-মানতেক, নীতিমালা অনুসরণ থাকতে হবে। তখনই প্রকৃত আলেম হওয়া যাবে। তাই, প্রচলিত সিলেবাস অধ্যয়ন করে এমন আলেম হওয়া যাবে না। ফলে দরছে নেজামীর পুনঃপ্রবর্তন যুগ ও সময়ের চাহিদা হয়েছে।
বর্তমান সাইয়্যেদ সাহেব হুজুর কেবলা এ ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ইলমে কিরআত ও মানসম্মত হতে হবে। পবিত্র দুই হেরমের তেলাওয়াতের ন্যায় কুরআন তেলাওয়াত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তরিকতের স্বাদ বুঝার জন্যে শরীয়তের জ্ঞান থাকতে হবে। পুরোপুরি শরীয়ত অনুসারী হতে হবে। বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রাধান্য থাকতে হবে। তখনই তরিকতের স্বাদ ভোগ করতে সক্ষেম হবে। আর শরীয়ত বলতে-কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসীর ইত্যাদির জ্ঞানকে বুঝাবে। তাই, মানসম্পন্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা নেহায়ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বেশভুষা নিয়ে আলেম হলে হবে না, বরং জ্ঞান-গুণ নিয়েই আলেম হতে হবে। আমল করেই নিজের জ্ঞানের যথার্থতার প্রমাণ দিতে হবে।’
বর্তমান সায়য়্যিদ সাহেব হুজুর বাতিলদের শত বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে তার ওয়ালেদে মুহতারত প্রতিষ্টিত মাদ্রাসা, মসজিদ ও খানকাহগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় মাসআলা শেখানো, হারাম, হালাল চেনা ও তা’লীম ও দা’ওয়াতের কর্মসূচি চালু করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে যে, শরিয়তের জ্ঞান যে দরবারের পীরের কাছে নাই, সে দরবারে শরিয়ত বিরোধী কার্যকলাপ বেশি হচ্ছে। আর পীর যদি শরিয়ী জ্ঞানশূন্য হয় তখন তার মুরিদরাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরিয়তের জ্ঞানশূন্য হবে। তখন সেখানে যেয়ারতের নামে নারী-পুরুষে অবাধ মেলামেশা বসবে। ছেমার নামে পশ্চিমা যন্ত্র সঙ্গীতের আসর জমবে।
প্রসঙ্গত, ওরশ-ফাতিহা শরীয়ত অনুমোদিত বিষয়। তাই, এসবের উদ্যাপনও শরীয়ত অনুমোদিত পন্থায় হতে হবে। শরীয়ত পরিপন্থি আচার দ্বারা শরয়ী-পার্বণ উদ্যাপন মানে হল- বাড়া ভাতের মধ্যে ধুলি-বালি ও ছাই-ছিটিয়ে দেয়া। হুজুর কেবলা সাইয়্যিদ শামসুল হুদা (রহ.) তার পুরো জীবনে শরীয়তকে আগলে রেখে তরীকতের চর্চা করে গিয়েছেন। এ বাস্তবতাকে জোরদার করার জন্যে তিনি জায়গা হতে জায়গায় মাদ্রাসা, হেফজখানা, এতিমখানা, মাহফিল ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। কারণ এ সবেতে শরীয়তের জ্ঞানার্জনের পর তরীকতের জগতে প্রবেশের যোগ্যতা এনে দেয়।
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, সংগঠক ও গবেষক
প্রভাষক (আরবি)- ছোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।