ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে। ইরানের জ্বালানি তেল ও তেলজাত রাসায়নিক রফতানি বন্ধ করতে বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন। কয়েক মাস ধরে আলোচনা সত্বেও তেহরান এখনো ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি কার্যকর না করায় এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। খবর আল জাজিরার।
সবশেষ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে ইরানের তেল ও তেলজাত পণ্য বিক্রির সাথে জড়িত চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা ব্রায়ান নেলসন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইরানের তেল ও তেলজাত পণ্য বিক্রি সীমিত করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইরান যতক্ষণ-না পরমাণু চুক্তিতে ফিরছে, ততক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে থাকবে।’
তবে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এ নতুন নিষেধাজ্ঞা কাজে আসবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, ২০১৮ সালে ট্রাম্পের চুক্তি প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা বহালের সিদ্ধান্তের পরও ইরানের তেল রফতানি প্রতি বছরই বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রভাব ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকার পরও ইরানের তেল বিক্রির প্রবণতারেখা উপরে উঠেই চলেছে।’
জুন মাসেই ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ইরান এখন প্রতিদিন দশ লাখ ব্যারেলের বেশি অপরিশোধিত তেল ও গ্যাস রফতানি করছে।’
প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ‘কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরও রাইসি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম কয়েক মাসে তেল বিক্রি ৪০ শতাংশ বেড়েছে।’
দীর্ঘ দিন ধরেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির দাবি, কর্মসূচির আড়ালে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে ইরান। এ ইস্যুতে জাতিসংঘের পাশাপাশি তেহরানের ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন। যার ফলে ইরানের অর্থনীতি নাজুক আকার ধারণ করে ও এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় সম্মত হয়।
আলোচনার ধারাবাহিকতায় পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ২০১৫ সালে ইরান পরমাণু চুক্তি নামে একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তিটি হয়েছিল ইরানের সাথে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া এবং জার্মানির। শেষ পক্ষ ‘পি৫ + ১’ হিসেবে পরিচিত।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের উপস্থিতিতে ওই চুক্তিতে সই করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ইরানের পক্ষে চুক্তি সই করেন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ওই চুক্তিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও মজুত করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
চুক্তি অনুসারে তেহরান তাদের কিছু পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করে দিতে অথবা পরিবর্তন করতে সম্মত হয়। এ ছাড়া ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের অনুমতিও দেয়া হয়। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত অনেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
এরপর উভয়ে ওই পরমাণু চুক্তি মেনেই চলছিল। কিন্তু মাঝে বাদ সাধেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় আসার বছর খানেক পরই ২০১৮ সালে ওই পরমাণু চুক্তিকে ‘সবচেয়ে বাজে চুক্তি’ অভিহিত করে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন তিনি।
একই সাথে ইরানের ওপর আগের সব নিষেধাজ্ঞা বহাল করেন। সেই থেকে ইরানের অর্থনীতির বিভিন্ন খাত যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। পাল্টা জবাব হিসেবে চুক্তির শর্ত মানা বন্ধ করে দেয় ইরান। চুক্তিতে নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিচ্ছে দেশটির সরকার।
কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ফের চুক্তিতে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০১৫ সালে যখন চুক্তিটি সই হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এরপর মূলত যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহেই ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর আলোচনা ফের শুরু হয়।
কয়েক মাস ধরে আলোচনার পর চূড়ান্ত খসড়া চুক্তি তৈরি হয়েছে। তবে সম্প্রতি উভয় পক্ষের দরকষাকষিতে আলোচনা স্থগিত হয়ে আছে। এর মধ্যেই ফের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সেই পুরোনো খেলা শুরু করেছে ওয়াশিংটন। সেই সাথে চলছে চাপ প্রয়োগও।
বৃহস্পতিবারই (২৯ সেপ্টেম্বর) বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ইরান চুক্তিতে ফিরে না আসা পর্যন্ত কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ অব্যাহত থাকবে।’