শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

ইসলা‌মে ধর্ষ‌ণের শাস্ত‌ি ও প্র‌তিকার

শুক্রবার, নভেম্বর ১, ২০২৪

প্রিন্ট করুন
আবদুল হান্নান চৌধুরী

আবদুল হান্নান চৌধুরী: আজ‌কে সারা দে‌শে ধর্ষণ মহামারী রূপ ধারণ ক‌রে‌ছে। এর জন্য আমা‌দের শিক্ষা ব্যবস্থাই মূলত দায়ী।‌ কো‌নে অপরাধ সংগ‌ঠিত হ‌লে‌ই শাস্ত‌ি‌র প্রসঙ্গ এ‌সে যায়। শুধু শাস্ত‌ি‌ বা আইন দি‌য়ে ‌কো‌নে অপরাধ দমন করা যায় না।‌ সে জন্য প্র‌য়োজন শিক্ষা প্র‌তিষ্ঠানগু‌লো‌তে নৈ‌তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

ন‌ৈ‌তিক শিক্ষা লাভের মাধ্যমে মানু‌ষের মধ্যে থাকা সু-প্রবৃত্তিগুলো বিকশিত হয় এবং পরবর্তী এগুলোরই প্রভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনও সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠে এবং সু-প্রবৃত্তি বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কু-প্রবৃত্তিগুলো অবদমিত হয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এসবের কোন প্রভাব তখন আর থাকে না।‌ কিন্তু, দুঃ‌খের বিষয় আমা‌দের দে‌শে অশ্ল‌ি‌লতা বন্ধ‌ে‌র যেমন কো‌নে উদ্যোগ নেই, তেম‌নি‌ জনগ‌ণের ন‌ৈ‌তিক চর‌ি‌ত্র সং‌শোধ‌নেরও কো‌নে ব্যবস্থা নেই । যার কার‌ণে দিন দিন ধর্ষণসহ খুন বে‌ড়েই চ‌লে‌ছে।

ধর্ষণের শাস্ত‌ি‌র ব্যাপা‌রে নিম্ন‌ে ইসলা‌মের বিধান তু‌লে ধরা হ‌ল।

ইসলামে ব্যভিচারকে অশ্লীল ও নিকৃষ্ট কাজ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি, এর জন্য পার্থিব ও অপার্থিব শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে আমৃত্যু পাথর নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ইসলামী শরিয়তে ব্যভিচারী বিবাহিত হলে তার শাস্তি রজম বা পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড। আর অবিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে ১০০ বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী- তাদের প্রত্যেককে ১০০ কশাঘাত করবে…।’ (সুরা : নুর, আয়াত: ২)

তবে, এ শাস্তি প্রয়োগ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসন। অন্য দিকে, কোন কারণে এ শাস্তি আরোপিত না হলে দুনিয়ায়ই কোন না কোনভাবে এর শাস্তি এসে যেতে পারে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখিরাতে। দুনিয়ার তিনটি হল চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া; দরিদ্রতা ও অকালমৃত্যু। আর আখিরাতের তিনটি হল আল্লাহর অসন্তুষ্টি; হিসাব-নিকাশের কঠোরতা ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই. ফা. পৃ. ১০৯)

ধর্ষিতার করণীয়: ব্যভিচারের সমগোত্রীয় অথচ তার চেয়েও ভয়ংকর অপরাধ হল ধর্ষণ। ইসলামে ব্যভিচারের পাশাপাশি ধর্ষণও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কোন ব্যক্তি যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে তার সর্বপ্রথম করণীয় হল সম্ভব হলে তা প্রতিরোধ করা। এমনকি যদিও তা ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মত পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে। সাইদ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি, সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭২; তিরমিজি, হাদিস : ১৪২১)

ইসলামী আইনবিদরা এ মর্মে ঐকমত্যে রয়েছেন যে, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে ধর্ষণের কারণে অভিযুক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তার কোন পাপ নেই। কেননা ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বল প্রয়োগ করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বল প্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫)

ধর্ষকের শাস্তি: ধর্ষণের ক্ষেত্রে এক পক্ষ থেকে ব্যভিচার সংঘটিত হয়। আর অন্য পক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত। তাই, মজলুমের কোন শাস্তি নেই। শুধু জালিম বা ধর্ষকের শাস্তি হবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সংঘটিত হয়- ব্যভিচার; বল প্রয়োগ ও সম্ভ্রম লুণ্ঠন। ব্যভিচারের জন্য কোরআনে বর্ণিত ব্যভিচারের শাস্তি পাবে। ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। ব্যভিচারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে ১০০ বেত্রাঘাত করা হবে। হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব মতে, ধর্ষণের জন্য ব্যভিচারের শাস্তি প্রযোজ্য হবে। তবে ইমাম মালেকের (রহ.) মতে, ধর্ষণের অপরাধে ব্যভিচারের শাস্তির পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। ‘মুহারাবা’ হল অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা কিংবা লুণ্ঠন করা। এক কথায় ‘মুহারাবা’ হল পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, লুণ্ঠন, নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ, ত্রাসের রাজ্য কায়েম করা ইত্যাদি। কোরআনে আল্লাহ ‘মুহারাবা’র শাস্তি এভাবে নির্ধারণ করেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি হচ্ছে : তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে বা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে কিংবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটি তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা, আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩৩)

এ আয়াতের আলোকে মালেকি মাজহাবে ধর্ষণের শাস্তিতে ‘মুহারাবা’র শাস্তি যুক্ত করার মত দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, সমাজে ধর্ষণ মহামারির আকার ধারণ করলে, সমাজ থেকে ধর্ষণ সমূলে নির্মূল করার লক্ষ্যে এ শাস্তি প্রয়োগ করা জরুরি। (আল মুগনি : ৮/৯৮)

আর যদি ধর্ষণের সঙ্গে হত্যাজনিত অপরাধ যুক্ত হয়, তাহলে ঘাতকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

সব শেষে একটি বিষয় স্মরণ রাখা জরুরি। সমাজ থেকে ব্যভিচার ও ধর্ষণ সমূলে নির্মূল শুধু দণ্ডবিধি ও আইনের কঠোরতার মাধ্যমে সম্ভব নাও হতে পারে। দণ্ডবিধি ব্যভিচার ও ধর্ষণ উপশমের একটি উপায়। কিন্তু, সবার আগে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি, খোদাভীতি ও তাকওয়াভিত্তিক সমাজ।