ঢাকা: গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান শান্তিতে নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘তিনি যে অপরাধ করেননি, তার জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।’
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এমন একটি অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়েছি, যা আমি করিনি। ‘আপনি যদি এটিকে ন্যায়বিচার বলতে চান, আপনি বলতে পারেন।’
সোমবার (১ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাকার শ্রম আদালত-৩-এ এই সাজার প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন।
ইউনূসের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান ও দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহানকে শ্রম আইনের ৩০৩ এর তিন ধারায় ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, অনাদায়ে আরো দশ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
একই আইনের ৩০৭ ধারায় তাদের সকলকে ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা।
গ্রামীণ টেলিকমের ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করা, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে।
৮৪ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক বলেছেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।’
তবে রায়ে সাজা হলেও আপাতত জেলে যেতে হচ্ছে না গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনূসসহ চারজনকে। পরে, আপিলের শর্তে ইউনূসসহ চারজনকে এক মাসের জামিন দিয়েছেন আদালত।
রায় শুনতে আদালতে বহু বিশিষ্ট নাগরিক উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় ইউনূসকে আদালত থেকে বাইরে নেয়া হয়।
সে সময় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আজ রায় ঘোষণা শুনতে আমার বহু বিদেশি বন্ধু-বান্ধব এসেছেন, যাদের সাথে বহু দিন দেখা হয়নি। আজ তাদের দেখে খুব আনন্দ লাগছিল।’
সোমবার (১ জানুয়ারি) দুপুর একটা ৪০ মিনিটে ইউনূস ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে হাজির হন। আদালতে ঢুকে এজলাসের পেছনের চেয়ারে বসে ছিলেন তিনি।
এ ছাড়া রায় শোনার জন্য অনেক বিশিষ্ট নাগরিক আদালতের এজলাসে হাজির হন। এরমধ্যে অন্যতম ছিলেন মানবাধিকারকর্মী আইরিন খান, সারা হোসেন, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল।
আইরিন খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউনূসের সাজার রায়ে তিনি বিস্মিত। ‘তাকে (ইউনূস) হয়রানি করার জন্যই এই সাজা দেয়া হয়েছে।’
বিচারক দুপুর দুইটার পরে আদালতের এজলাস গ্রহণ করেন। পরে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। বিচারক বলেন, ‘৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে সব পড়া সম্ভব নয়।’
এরপরে বিচারক বলেন, ‘আজ নোবেল জয়ী ইউনূসের বিচার হচ্ছে না। এখানে বিচার করা হচ্ছে গ্রামীন টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে। আমি শুধু জিস্টটা পড়ে শোনাচ্ছি।’
বিচারক রায় পড়ার সময় ইউনূসের আইনজীবী মামুন বহু বার বিচারককে বলেন, ‘তাদের বক্তব্য রায়ে আনা হয়নি। এতে আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’
বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘ইউনূসের মামলায় চারজন সাক্ষী দিয়েছেন। মামলার বাদী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান কর্তৃক মামলা কোন ত্রুটি হয়নি। এ ছাড়া মামলা দায়েরে কোন বিলম্ব হয়নি। তিনি যথাসময়ে এই মামলা করেছেন।’
বিচারক রায়ে আরো বলেন, ‘এ মামলায় আরো অন্য পরিচালক রয়েছে, যাদের আসামি করা হয়নি- এমন বক্তব্য আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী আরো বলেছেন, শুধু ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠজনদের এ মামলায় আসামি করা হয়েছে, যা সত্য নয়। কারণ, বার্ডেন অব প্রুফ অর্থাৎ প্রমাণের দায়িত্ব আসামির ওপরে বর্তায়। এসব কারণে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, শ্রম আইন লঙ্ঘন হয়েছে।’
মামলায় অভিযোগে বলা হয়, ‘কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে তারা শ্রম আইনের লঙ্ঘনের ব্যাপারে জানতে পারেন। এর মধ্যে ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি। শ্রমিকদের অংশগ্রহণের তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি।
এর আগে গেল ২২ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গেল ৮ নভেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেন আসামিরা। গেল ৮ মে মামলা বাতিলের আবেদন খারিজের বিরুদ্ধে ইউনূসের লিভ টু আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর ৬ জুন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
মামলায় মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজন বিবাদীর আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখিত বক্তব্য জমা দেয়া হয় আদালতে। সেখানে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকম যেসব ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে সেগুলো চুক্তিভিত্তিক। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তা নবায়নের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়।’
গ্রামীণ টেলিকমের প্রকল্প নোকিয়া কেয়ার ও পল্লীফোনের কার্যক্রম তিন বছরের চুক্তি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। মেয়াদ শেষে তা নবায়ন হয়। যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত তাই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।