বেইজিং, চীন: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেনের চীন সফরকালে দুই দেশ উত্তেজনামূলক সম্পর্ককে স্থিতিশীল করার দিকে নজর দিলেও মূল সমস্যাগুলো অমিমাংসীতই রয়ে গেছে। তাই, সম্পর্ক এখনো ঝুঁকিপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা ব্লিঙ্কেনের সফর থেকে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখছেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সফরকালে কেবলমাত্র সাধারণ কিছু অঙ্গীকার ও আশ্বাসই করা হয়েছে।’
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সোমবার (১৯ জুন) ব্লিঙ্কেনের সফরের একেবারে শেষ পর্যায়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উভয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ব্লিঙ্কেনের সফরকে ইতিবাচক বর্ণনা করে একে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অগ্রগতির আভাস বলে উল্লেখ করেছেন।
বেইজিংয়ে ব্লিঙ্কেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এটি খুবই স্পষ্ট যে, অস্থিতিশীল পর্যায়ে থাকা সম্পর্কটিকে স্থিতিশীল করার প্রয়োজনীয়তা উভয়ে স্বীকার করে নিয়েছে।’
শির সাথে গ্রেট হল অব দ্য পিপল-এ ৩৫ মিনিটের বৈঠক শেষে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আরো বলেছেন, ‘আমি যেটাতে জোর দিয়েছি, ঊর্ধ্বতন স্তরে টেকসই যোগাযোগই হচ্ছে পার্থক্যগুলো কাটিয়ে ওঠার ও প্রতিযোগিতা যাতে সংঘাতের দিকে না যায়, তা নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায়।’
কিন্তু, ৬১ বছর বয়সী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘চীন সম্পর্কে তার ‘পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি’ রয়েছে ও ‘চীনের অনেক ইস্যুতে আমরা গভীরভাবে এমনকি তীব্রভাবে দ্বিমত পোষণ করি।’
গেল প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে চীনে কোন শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিকের এটিই প্রথম সফর। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্লিঙ্কেনই সবচেয়ে সিনিয়র নেতা; যিনি চীন সফর করলেন। কিন্তু, এ সফরকালে ট্রাম্প-আমলের বাণিজ্য যুদ্ধ, তাইওয়ানকে নিজেদের বলে বেইজিংয়ের জোরালো দাবি ও চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে কথিত চীনা গুপ্তচর বেলুন উড্ডয়নের প্রেক্ষাপটে কার্যত ভেঙে পড়া বেইজিং ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কে কতটুকু ইতিবাচকতার আভাস পাওয়া গেছে, সে সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান মার্শাল ফান্ডের চীনা বিশেষজ্ঞ বন্নি গ্লেসার বলেছেন, ‘আগামী বছর তাইওয়ানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে চীন আরো সতর্ক হয়ে উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘দুই পক্ষ মূলত সম্পর্ক স্থিতিশীল করার উপায় খুঁজতে সম্মত হয়েছে। তবে, তারা এ লক্ষে পৌছাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।’
গ্লেসার আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে, সেখানে শি বড় দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলার কথা বলেন।’
তাইওয়ান মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বিরোধের সবচেয়ে বড়ো ইস্যু এবং এ ইস্যুতে উভয় দেশের বিরোধ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর আশঙ্কাও রয়েছে। চীন স্ব-শাসিত তাইওয়ানকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসাবে দেখে ও একে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। কিন্তু, তাইওয়ান তার নিজস্ব সংবিধান ও নেতাদের সাথে চীনের মূল ভূখন্ড থেকে নিজেকে আলাদা মনে করে। আর শি জিনপিং ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি তার মেয়াদেই তাইওয়ানকে বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে নিতে চান।
এ দিকে, জো বাইডেন গেল বছর বলেছেন, ‘চীন আক্রমণ চালালে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে রক্ষা করবে।’ বাইডেনের এ মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল শি।
কিন্তু, সোমবার (১৯ জুন) অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ওয়াশিংটন তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না।’
তিনি বলেন, ‘চীনও কিছু আশ্বাস দিয়েছে। একইসাথে ইউক্রেনে ব্যবহার করার জন্য রাশিয়াকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সাহায্য না করারও অঙ্গীকার করেছে বেইজিং।’
ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় থেকেই শি ও বাইডেন একে অপরকে ভাল করে চেনেন। গেল বছর বালিতে উভয় নেতার প্রথম বার সাক্ষাৎ ঘটে। তারা উভয়ে সে সময়ে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে সম্মত হন।
কিন্তু, বালির এ সুবাতাস বেশি সময় টেকে নি। ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় একটি সন্দেহভাজন চীনা গুপ্তচর বেলুন উড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সম্পর্কে আকস্মিক ভাঙন আরো তীব্র হয়। সে সময়ে চীনে ব্লিঙ্কেনের সফরে যাওয়ার কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়।
ব্লিঙ্কেনের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক কতটুকু গতি পাবে- এ বিষয়ে চীনের রেনমিন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শি ইয়ানহং বলেন, ‘ব্লিঙ্কেনের সফরের পরও সম্পর্ক এখনো ঝুঁকিপূর্ণ।’
তিনি আরো বলেন, ‘বৃহত্তর যোগাযোগ ও সংকীর্ণ সহযোগিতা অবশ্যই ইতিবাচক, যদিও তা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন।’