আব্দুল আউয়াল, ঠাকুরগাঁও: ঠাকুরগাঁওয়ে ঐতিহ্যবাহী ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নববধূরা দলে দলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে ছুটছেন। স্বামীর মঙ্গল কামনায় ১ ভাদ্র থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে শুরু হয়েছে ভাদর কাটানি। এ উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে চলছে নানা আয়োজন।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, ভাদ্রের প্রথম তিন দিন স্বামী নব বধূর মুখ দেখলে তার ও স্বামীর অকল্যাণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই, বিয়ের পর প্রথম পাওয়া ভাদ্রের তিন দিন বাপের বাড়িতে অবস্থান করেন নব বধূরা। এর কোন দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এ এলাকার মানুষ এসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন। প্রাচীনকাল থেকে আজো এই উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। রীতি অনুযায়ী, নব বধূরা এ সময় সাধারণত বাবার বাড়িতে অবস্থান করেন ও স্বামীর মঙ্গল কামনা করেন।
তিন দিন স্বামীর মুখ দেখবেন না বলে নব বধূরা এ সময়ের জন্য বাবার বাড়িতে নাইওর যান। গেল বছর আশ্বিন থেকে চলতি বছর শ্রাবণ পর্যন্ত যাদের বিয়ে হয়েছে, তাদের নিয়েই এই আয়োজন।
উৎসবটি পালনে নব বধূদের বাড়িতে পড়ে যায় সাজ-সাজ রব, থাকে নানা আয়োজন। নব বধূরা যে কয় দিন বাবার বাড়িতে অবস্থান করবেন, সে কয় দিন তারা সামর্থ্য অনুযায়ী মেয়েকে ভাল-মন্দ খাওয়াবেন। প্রচলিত এ প্রথাটি যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে এভাবেই চলে আসছে। তবে, কবে থেকে কীভাবে এ প্রথার শুরু, তার সঠিক তথ্য কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
নব বধূকে আনতে তার ছোট ভাই, বোন, বান্ধবী, নানি, চাচি, ফুফু ও প্রতিবেশীরা যাবেন বরের বাড়িতে। সাথে নেবেন সামর্থ্যমত মুড়ি, পায়েস, নানা রকমের ফল ও মিষ্টি। কেউ ভাদ্রের আগের দিন, আবার কেউ কয়েক দিন বাকি থাকতেই যান বরের বাড়িতে। বর পক্ষ সাধ্যমত তাদের আপ্যায়ন করান।
এরপর বর পক্ষের লোকজনও কনেকে আনতে যান। তারা সাধ্যমত ফল, মিষ্টি, পায়েস, মুড়ি, মুড়কি, দই প্রভৃতি নিয়ে যান।
স্থানীয় প্রবীণ লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাচীন এ লোকাচার তারা দেখে আসছেন। এই উৎসবটি প্রাচীন সংস্কৃতির সাথে মিশে রয়েছে। কেউ কেউ একে কুসংস্কার বললেও সামাজিক রীতির ভাদর কাটানি স্থানীয় লোকেরা শ্রদ্ধার সাথে পালন করেন।
সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নের ভেলাজান এলাকার আবু তালেবের মেয়ে শিউলি আকতারের তিন মাস আগে বিয়ে হয়েছে। তিনি ভাদর কাটানির অংশ হিসেবে এসেছেন বাবার বাড়িতে।
শিউলি বলেন, ‘বিয়ের পর ভাদর কাটানি পালন করতে বাবার বাড়ি এসেছি।’
স্কুলের শিক্ষক স্বপন কুমার রায় বলেন, ‘ভাদর কাটানি হল আমাদের সমাজের প্রাচীন একটি প্রথা। এটা লোকাচার হলেও আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ উৎসব আমরা জন্ম থেকেই দেখে আসছি। নব বিবাহিত প্রত্যেক দম্পতির জীবনে এটা এক বার আসে। তবে, এক সময় এই প্রথা অনুযায়ী, পুরো ভাদ্রে নতুন বিবাহিত দম্পতিরা একে অপরের মুখ দর্শন নিষেধ থাকলেও এখন তিন দিন পালন করছেন।’
ভাদর কাটানি নিয়ে নানা মানুষের নানা মত থাকলেও এটি ঠাকুরগাঁওয়ের একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বার্তা বহন করে। বাংলার নারীর হৃদয়ে পতি ভক্তির এ সংস্কৃতি এখানকার নারীদের যেমন উজ্জ্বল করেছে, তেমনি সমৃদ্ধ করেছে আবহমান কালের সংস্কৃতি।