মো. নুরুল কবির: চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের পর্যটন খাতে রাজস্ব আদায়ে সব থেকে বেশি ভূমিকা রাখে। ভৌগলিক সীমারেখায় দেশের এক দশমাংশ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর চট্টগ্রাম; যা বন্দর নগরী নামে দেশ বিদেশে পরিচিত। প্রাচীন আমলে যার নাম ছিল চট্টলা বা চাটগাঁ। হাজার বছর আগে থেকে বিদেশি বণিক, পরিব্রাজক আর শাসকদের জন্য ছিল আকর্ষণীয় অঞ্চল। আরব বণিক থেকে শুরু করে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ইরান-ইরাকের নানা দেশের মানুষ বসতি গেড়েছে কেউ বা প্রতিষ্ঠা করেছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। সৌন্দর্যের অবয়ব পাহাড়, নদী আর সাগরের অপূর্ব মেলবন্ধন। তবুও কেন আজো অবহেলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলায় নানামুখী পর্যটন স্পট রয়েছে। এর মধ্যে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ ও উরিরচর চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যময় পর্যটনের অন্যতম বিনোদনের স্থান।
চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরেই রয়েছে ওয়ার সিমেট্রি, সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি), পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, বাংলাদেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, ফয়স’ লেক, ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, হালিশহর খেঁজুরতলা বিচ, বায়েজিদ বোস্তামির মাজার ও ওখানকার শতবর্ষী কাছিম দর্শন, বার আউলিয়াদের বিভিন্ন মাজার, ১৫০ বছরের পুরনো আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার, লালদীঘি মসজিদ, আসকার দিঘী, আগ্রাবাদ ঢেবা, পাহাড়তলি জোড় ঢেবা, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শতবর্ষের পুরনো চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, বলুয়ার দিঘী, দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাটকল আমিন জুট মিলস, জিয়া জাদুঘর, নেভাল একাডেমি পর্যটন স্পট, বাটারফ্লাই পার্ক, অভয়মিত্র ঘাট, শাহ আমানত সেতু, শতবর্ষী পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, কর্ণফুলী নদী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মিঠাপানির কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন নদী হালদা, পরীর পাহাড়, কোর্ট বিল্ডিং, ডিসি অফিস, বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের আবক্ষ মূর্তি, চট্টেশ্বরী মন্দির, বৌদ্ধবিহার, ডিসি হিল, ম্যানোলা পাহাড়, দেব পাহাড়, দেশের প্রধান সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারি ঘাট, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শতবর্ষী রেলওয়ে সেতু, সমুদ্র ভ্রমণ, রাশমনি ঘাট, পাহাড়বেষ্টিত বায়েজিত লিংক রোড, জাম্বুরি মাঠ, রেলওয়ে যাদুঘর, বিপ্লবী বীরকন্যা প্রীতিলতা স্মৃতি স্থাপনা, বাটালী পাহাড়, পোর্ট ভিউ, বায়েজিদ ইকোপার্ক, জাতিসংঘ পার্ক, বিপ্লব উদ্যান, টাইগার পাস, চিড়িয়াখানা, একাধিক শিশুপার্ক, মিনি বাংলাদেশ, পর্তুগিজ দুর্গ, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বিভিন্ন শতবর্ষী স্থাপনাসহ বৈচিত্র্যময় সব পর্যটন স্থাপনা।
চট্টগ্রাম শহরের সমুদ্র ও নদী তীরবর্তী স্থানগুলো দিয়ে নির্মিত মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোর্য়াটার ছিল চট্টগামে। যার ফলে চট্টগ্রাম শহরের একটি বড় অংশই রেলওয়ের মালিকানাধীন। সিআরবি, আকবর শাহ, পাহাড়তলি, আমবাগানসহ সিটি করপোরেশন এলাকার অন্তত কয়েক হাজার একর জমি এখনো বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রাধীন। ফলে চট্টগ্রামের যেখানেই ভ্রমণ করা হোক, রেলওয়ের ব্রিটিশ আমলের নির্মিত বৈচিত্র্যময় স্থাপনা, পাহাড়, সড়ক বিদ্যমান। প্রায় ৩৬৬ একরের কৃত্রিম হ্রদ ‘ফয়স’ লেক’ চট্টগ্রাম শহরের সৌন্দর্য্যকে কয়েক গুণ বাড়িয়েছে।
এক সময় রেলওয়ে মানেই ছিল বন্দর। ব্রিটিশরা রেলওয়ে ও বন্দরকে একসঙ্গেই বাংলা অঞ্চলের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদন করত। পরবর্তী রেলওয়েকে ভেঙে বন্দরকে স্বতন্ত্র করলেও এখনো চট্টগ্রামকে রেলের শহর নামেই চেনে মানুষ। তবে পার্বত্য জেলাগুলো বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি তুলনামূলক উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে অবহেলিত রয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দৃষ্টিনন্দন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি কৃষ্টি আচার-অনুষ্ঠানে সমৃদ্ধ বিচিত্র জীবন ধারা, পাহাড়ি স্বচ্ছ জলের লেক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যময় স্থান, বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ এবং বুনো পশু ও পাখ-পাখালির মিষ্টি কলরবে মুখরিত অভায়রণ্যে সমৃদ্ধ পার্বত্যাঞ্চলে রয়েছে পর্যটন শিল্পের অমিত সম্ভাবনা। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে পর্যটন শিল্প থেকে।
কিন্তু নানামুখী সমস্যায় বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল এ শিল্প এখানে কাঙ্ক্ষিত অবস্থান থেকে অনেক দূরে। বিশ্বায়নের যুগে পুরো পৃথিবীময় যে পরিবর্তন, সে প্রেক্ষাপটে পর্যটনের ক্ষেত্রে যতটা অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অবস্থানে ততটা অগ্রগতি হয়নি। এ ক্ষেত্রে পর্যটনবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন দরকার। পাহাড়াঞ্চলের উন্নয়নে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য জেলা পরিষদসহ পর্যটন কর্পোরেশনের সমন্বিত প্রয়াস ও অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।
পার্বত্য জেলাগুলোর ভ্রমণে দেখার মধ্যে রয়েছে ৩৩৫ ফুট লম্বা রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত ব্রিজ, শুভলং ঝর্ণা, কাপ্তাই লেক, উপজাতীয় জাদুঘর, রাজবন বিহার, চাকমা রাজবাড়ি, নৌবাহিনী পিকনিক স্পট, বেদবুনিয়া উপগ্রহ কেন্দ্র, ইকো ভিলেজসহ নয়নাভিরম ঝরনা।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে কিছুটা শান্তি বিরাজ করলেও বর্তমানে তা ফের মাথা ছাড়া দিয়েছে। যার মূল কারণ পাহাড়ি অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। যার ফলে পর্যটকরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। পর্যাপ্ত টুরিস্ট পুলিশ নিয়োগ, চুরি ছিনতাই ও ইভটিজিং বন্ধ, উন্নত কটেজ ব্যবস্থা, আধুনিক রাস্তাঘাট নির্মাণ, টয়লেট সুবিধা, দক্ষ গাইডার, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার প্রচারণা হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাঙ্খিত সৌন্দর্য উপভোগের স্থল। যুক্ত হতে পারে দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা। তবে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, পরিবেশ বিপর্যয় করে কোন কাজ করা যাবে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঠিক রেখে সব উন্নয়ন সম্পাদিত করতে হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগর শাখা।