ঢাকা: টানটান উত্তেজনা নিয়ে দর্শকরা ঘিরে রেখেছে দশ বাই সাড়ে ১২ মিটারের একটি আয়তাকার ক্ষেত্র। দুই পাশে সাতজন করে খেলোয়াড়। এর মধ্যে হঠাৎ একজন এক দমে হা-ডু-ডু-ডু-ডু করতে করতে বিপরীত পাশে থাকা দলের দিকে এগিয়ে গেল। দম থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ছুঁয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরতে হবে তার। দম আর শক্তির এ খেলায় সে কি ঘরে ফিরতে পারবে, না কি প্রতিপক্ষের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে নিজেই খেলা থেকে ছিটকে পড়বে? গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ও উত্তেজনাপূর্ণ হা-ডু-ডু খেলার এমন আয়োজন এখন বলতে গেলে আর চোখেই পড়ে না।
ইট-কাঠের নগরে খেলার জায়গা সংকুচিত হয়ে আসা আর নাগরিক ব্যস্ত জীবনের কারণে শহরে তো বটেই, গ্রামেও হা-ডু-ডু খেলা এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এক সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় এ খেলাটিরই অনন্য সংস্করণ কাবাডি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কাবাডিকে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন।
জাতীয় খেলার মর্যাদা আর ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার বাইরে গ্রামাঞ্চলে তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা স্বত্তেও কাবাডি নিয়ে আর আগের মত উত্তেজনা নেই। অর্থায়ন আর পৃষ্ঠপোষকতা সংকটের মত নানা কারণে দেশে দক্ষ ও পেশাদার কাবাডি খেলোয়াড় গড়ে উঠছে না। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে এশিয়ান গেমসের কাবাডি খেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। তবে, ফলাফল হিসাব করলে দেখা যাবে, সেখানেও তেমন দৃশ্যমান কোন উন্নতি নেই। ১৯৯০, ১৯৯৪ ও ২০০২ সালের এশিয়ান গেমস আসরের কাবাডি (পুরুষ) খেলায় রৌপ্যপদক আর ১৯৯৮ ও ২০০৬ সালের আসরে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী বাংলাদেশ ২০১০ থেকে পরের আসরগুলোয় প্রথম চারেই থাকতে পারেনি।
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে সাধারণত ক্রিকেটকেই বিবেচনা করা হয়। এরপর রয়েছে ফুটবল, টেনিস, হকি, ভলিবল, হ্যান্ডবল, গলফের মত আন্তর্জাতিক খেলাগুলোও দেশে একদম কম জনপ্রিয় নয়।
বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে খেলাধুলার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আবার হা-ডু-ডুর মত খেলাগুলো দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও প্রতিনিধিত্ব করে। দেশে কাবাডির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, বলি খেলা ইত্যাদি। ক্রীড়াপ্রেমীদের মাঝে কাবাডিকে জনপ্রিয় করে তুলতে এ সম্পর্কিত সব ধরণের খবর নিয়ে পারিম্যাচ নিউজ তো রয়েছেই।
শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, কাবাডি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েই জনপ্রিয় খেলা। প্রতিবেশী দেশ ভারত সাম্প্রতিক সময়ে কাবাডির মত আঞ্চলিকভাবে জনপ্রিয় খেলাগুলোকে বিশ্ব পর্যায়ে তুলে ধরতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে পেশাদার কাবাডি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা। ২০১৪ সালে ভারত প্রথম বারের মত ‘প্রো কাবাডি লিগ’ আয়োজন করে। আইপিএল, বিপিএল এসব ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের মতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে প্রো কাবাডি লিগ। করোনা মহামারির কারণে এক বছর বাদ দিয়ে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই হয়েছে এ তুমুল জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট। আগামী ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে প্রো কাবাডি লিগের দশম আসর, যার টাইটেল স্পন্সর হিসেবে রয়েছে ভিভো। এছাড়া, অ্যাসোসিয়েট স্পন্সর হিসেবে রয়েছে ড্রিম১১ ও এ২৩ রামি। আয়োজনটির গর্বিত অংশীদার হিসেবে যুক্ত হয়েছে পারিম্যাচ নিউজ, আলট্রাটেক সিমেন্ট ও জিন্দাল প্যানথার।
প্রো কাবাডি লিগের মত টুর্নামেন্ট আয়োজনের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতে এক দিকে আবার জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে কাবাডি, অন্য দিকে, এর মাধ্যমে দক্ষ কাবাডি খেলোয়াড়রা বের হয়ে আসছেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজেদের কৌশল ও নৈপুণ্য দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন অনেক তরুণ খেলোয়াড়। এর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে স্থানীয় পর্যায়েও এখন গড়ে উঠছে কাবাডি দল ও ক্লাব। জাতীয় খেলা কাবাডির জনপ্রিয়তা বাড়াতে প্রতিবেশী দেশের মত বাংলাদেশেও এ ধরনের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা যেতে পারে। দেশে এ ধরনের টুর্নামেন্ট আয়োজন করার ক্ষেত্রে স্পন্সর না পাওয়াকে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ত্রিদেশীয় প্রো-বক্সিং টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়, যার স্পন্সর হিসেবে সহযোগীতা করে এক্সসেল। বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনও যদি এ রকম স্পন্সরদের আকৃষ্ট করতে পারে, তাহলে প্রতি বছর ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আয়োজন করাও কঠিন হবে না।
দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হলে জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে খেলোয়াড়রা বের হয়ে আসার সুযোগ পাবে। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সেরাদের বাছাই করার সুযোগ পাবে ফেডারেশন। এতে করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার মত জাতীয় দল গঠন করা আরো সহজ হবে। এক দিকে, বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, অন্য দিকে, জাতীয় খেলাকেও দিতে পারব যথাযোগ্য মর্যাদা।