মোহাম্মদ ওয়াসিম: ‘প্রিয় নজরুল
তোমার জীবন তো রহস্যেভরা মহাসাগরের একুল-ওকুল
তোমার জীবন ভেদ করে এখনো
পাই না কোন কূল। প্রিয় নজরুল’।
চির স্মরণীয়, চির বরণীয়, বিদ্রোহী, বিপ্লবী, সম্প্রীতির মানবিক মানুষের কবি, প্রিয় নজরুল। বাঙালি মনীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন কাজী নজরুল ইসলাম। এই অমর কবির ৪৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে মহাত্মার চির শান্তি কামনা করি ও তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। কবি নজরুল লেখায় ও জীবনে এবং পেশায় ও প্রেমেও ছিলেন বিদ্রোহী। এর স্পষ্ট ছাপ তার জীবন যুদ্ধে তো বটেই; কবিতার ছন্দে আর গানের সুরেও। সনাতন পদ্ধতিতেও এনেছিলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ….
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির…
কবি নজরুলের প্রতিভা বহুমুখী হলেও তার আসল পরিচয় কবি। বিদ্রোহী কবি, বিপ্লবী কবি। তিনি চিরকাল কর্মে ও চিন্তায় স্বাধীন এবং দাসত্বের বন্ধন মুক্তি ও প্রাচীন সংস্কারের শৃঙ্খল ভঙ্গ করার কামনায় উন্মাদ। তিনি একাধারে শ্রেষ্ঠ কবি, সুর শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, গায়ক এবং ভাব প্রধান, গাল্পিক, উপন্যাসিক ও নাট্যকার। তার প্রত্যেকটি কবিতার ভিতর দিয়ে বিদ্রোহীর অগ্নিশিখা পাঠক হৃদয়কে স্বাধীনতার নেশায় মাতাল করে। তিনিই সৈনিক নজরুল, বিপ্লবী নজরুল, বিদ্রোহী নজরুল। তারই হুংকারে ঘুমন্ত নাগরিকদের হৃদয়ে চেতনা দান করেছে। আর এনেছে প্রলয় মহা প্রলয়।
নজরুল সম্পর্কে ১৯২৯ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের বাণী ‘কারাগারে আমরা অনেকেই যাই। কিন্তু, সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ, অনুভূতি কম। নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়, এটা সত্য কথা। তার অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনো তার গান গাইব। যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, সেখানে যুদ্ধের গান হবে। আমি বিভিন্ন দেশের অনেক গান শুনেছি। কিন্তু, তার ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মত প্রাণ মাতানো গান আর কোথাও শুনিনি।’
নজরুল জন্মগত বিপ্লবী। তিনি ন্যায়ের জন্য কখনো কুণ্ঠাবোধ করতেন না। নজরুলের এই স্বভাবসুলভ বিপ্লবী চেতনায় ধারায় তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন। নিগৃহীত হয়েছিলেন। কিন্তু, থামেনি তার কলম, থামেনি তার যুদ্ধ। ‘মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত। যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। অত্যাচারির খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না। (বিদ্রোহী)
উপনিবেশবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে তার গগন বিদারি চিৎকার, আমি রূষে উঠি যবে মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া, (বিদ্রোহী)
কিংবা তথাকথিত প্রভুদের বিরুদ্ধে তার হুংকার, আমি ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন, আমি খেয়ালি বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন। (বিদ্রোহী) আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহীর গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা, কলুষিত পুরাতন, পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে।
নজরুল বলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম নিয়েছি। এরই অভিযান সেনা দলের তুর্য বাদকদের একজন আমি। এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ বিপ্লবী হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের সমকক্ষ বাংলাদেশে কোন কবি, সাহিত্যিকের জন্ম হয় নাই। তিনি ভারতে স্বাধীনতার বিপ্লবীদের অগ্রদূত। যে মহান কবি তার বিদ্রোহী কবিতায় শুরুতেই ঘোষণা করেন, বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি, ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন আরশ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির বিস্ময়। আমি বিশ্ব বিধাত্রীর, বল বীর বল উন্নত মম শির।’ সেই তিনি আবার বাতায়নপাশে গুবাক তরুর সারি, কবিতায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না। কোলাহল করি সারাদিন মান কারো ধ্যান ভাঙিব না, নিশ্চল নিশ্চুপ, আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ-বিধুর ধুপ।’ রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই বলতেন, ‘দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে। তুই প্রস্তুত হ!’ নজরুলের অসুস্থ সময়টাই হল নির্বাক জীবন। নজরুলের মত এত বড় মাপের সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনে এটি হল বড় ট্রাজেডী। যে পরিণত বয়সে তিনি সাহিত্য-সংগীতের উচ্চতর সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন, সেই সময়েই তিনি বাস্ত শক্তি রহিত হয়ে নির্বাক-নিশ্চুপ ছিলেন।
নজরুলের অসুখ প্রথম ধরা পড়ে ১৯৪২ এর ৯ জুলাই। মুজফফর আহমদ তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিতরূপে ধরে নিতে পারি যে, ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই নজরুলের অসুখটা সকলের নিকট প্রথম ধরা পড়েছিল। যদিও অসুখ অনেক আগেই হয়েছিল।’ সুফী জুলফিকার হায়দার তার ‘বিদ্রোহী নজরুল নীরব আজি’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘১৯৪২ সালের ১০ জুলাই কবি নজরুল ইসলাম- আমার পরম সুহৃদ কাজীদা আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও তার অসুস্থ অবস্থার সংবাদ পত্রযোগে আমাকে তিনি জানান।’ কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে ছিলেন ১৮৯৯-১৯৭৬ পর্যন্ত। অর্থাৎ ৭৭ বছর তিন মাস পাঁচ দিন। সুস্থ ও কর্মপ্রবল ছিলেন ১৮৯৯-১৯৪২ পর্যন্ত। অর্থাৎ, ৪৩ বছর এক মাস ১৫ দিন। অসুস্থ, সম্বিতহারা ছিলেন ১৯৪২-১৯৭৬ পর্যন্ত। অর্থাৎ, ৩৪ বছর এক মাস ২০ দিন।
প্রমীলা নজরুল অসুস্থ হয়েছিলেন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে, তার নিম্নাঙ্গ অবশ ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছেন। তিনি যে খাটে শুতেন, সে খাটের নিচে ছিল নিজের সংসার। দা-বটি, ফল-মূল, তরি-তরকারী সবকিছু। শুয়ে শুয়েই তিনি রান্নার কাজে সহায়তা করতেন, মেহমানদারী করতেন, সন্তানদের এটা-ওটা দিতেন, বিশেষ করে স্বামী নজরুলকে নিজ হাতে খাওয়াতেন। গিরিবালা দেবীর নিরুদ্দেশ হওয়ার পর তার এ তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। মহিয়সী, ধৈর্যশীলা এই রমণী জীবনে আঘাতের পর আঘাত পেয়ে জর্জরিত হয়েছেন। প্রথম আঘাত তার প্রথম সন্তানের অকাল মৃত্যু, দ্বিতীয় আঘাত দ্বিতীয় পুত্রের মৃত্যু, তৃতীয় আঘাত তার নিজের মরণব্যাধি অসুখ, চতুর্থ আঘাত স্বামীর কালরোগ, পঞ্চম আঘাত মায়ের অন্তর্ধান। এত কিছুর পরেও তিনি সংসার সামলানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, শেষ বলে কথা আছে। ৩০ জুন ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবাইকে ছেড়ে চলে যান। প্রমীলার কবর হয়েছিল তার ইচ্ছা অনুযায়ী চুরুলিয়ার পর পুকুরের পাশে।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ কাজী নজরুল ইসলামের পুরো জীবনে এক মহা আশির্বাদ। এ সময় থেকেই তার কপালে একের পর এক সম্মানের তিলক পড়তে থাকে। জন্মস্থান চুরুলিয়ার মানুষ তাকে চেনেনি, কলকাতার মানুষ তাকে চেনেনি, পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিরা তাঁকে চেনেনি। কিন্তু, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও তার জনগণ তাকে ঠিকই চিনেছিল। ‘মানিকে মানিক চেনে’ কথায় বলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ এর ২৪ মে বাংলাদেশ বিমানে করে কবিকে সপরিবারে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। তারপর ধানমন্ডি ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০-বি একটি সরকারি বাড়িতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছিল নজরুল জীবন মহাস্মরণীয় ও সম্মানের দিন। জনমানুষের কবি, সাম্যবাদের কবি, জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি, বাঙালির কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। নির্বাক নিশ্চুপ কবি কি কিছু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন? এখানেই শেষ নয়। তার জন্য ছিল আর এক মহা সম্মান, মহা পুরস্কার দেশের মানুষের প্রীতি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অর্থ হিসেবে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’ এ ভূষিত করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মুহম্মদ সায়েম আনুষ্ঠানিকভাবে নজরুলকে এই পদক পরিয়ে দেন।
২৪ মে কবির জন্মদিনে তাকে তদানীন্তন সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে আর্মি ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান হাসপাতালে গিয়ে কবির হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন এবং ‘চল চল চল’ গানটিকে বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আগস্ট মাস থেকেই কবির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। শরীরে পানি আসে, তার শারীরিক অবস্থা বিশেষ উদ্বেগজনক হয়ে উঠে। কবির দেহের তাপ কমিয়ে আনার জন্য শেষ চেষ্টা হিসেবে শরীর স্পঞ্জ করানো হয়। নির্বাক কবি ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট রোববার সকাল দশটা দশ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ভাগ করে অনন্ত নির্বাকের পথে যাত্রা করেন। কবির মৃত্যুকালে তার শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক হাসপাতালের সুপার ডাক্তার আশিকুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী ও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিকসহ লক্ষ লক্ষ লোকের অংশগ্রহণে স্মরণাতীতকালের এক বিশাল জানাজা শেষে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় সামরিক মর্যাদার ২১ বার তোপধ্বনি সহকারে কবিকে সমাহিত করা হয়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দর জুলাইয়ে এইচএডি থেকে মুহম্মদ কাশেমের কন্ঠে কবির লেখা ও সুরে ইসলামি গানের একটি রেকর্ড বের হয়। বাণীতে কবির অভিব্যক্তি ছিল, ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ তার ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছে। ঢাবির মসজিদ প্রাঙ্গণের পাশে সমাহিত করা হয় তাকে; যেন কবি মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পান।
তার যাবতীয় লেখা সত্য, সুন্দর,শ্বাশত ও বিশ্ব মানবতাকে ঘিরে আবর্তিত, পরিণত ও কালোত্তীর্ণ। তার কবিতায়, গানে, গল্পে ও অন্যান্য লেখার চরণে চরণে যে সত্য ও সুন্দরের অবগাহন, তা বিশ্বের সব ভাষা আর সাহিত্যের উপজীব্য। তিনি সত্য ও সুন্দরের কবি, মানুষের কবি। তাই তিনি বিশ্বজনীন। স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমরা তার কাছে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।
লেখক: বংশীবাদক ও সংস্কৃতিকর্মী, চট্টগ্রাম।