লাইফস্টাইল প্রতিবেদন: ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রশিক্ষণ দিতে নয় শুধু, রমজানের আগমন ঘটে একটি সুস্থ জীবন পরিচালনার বার্তা নিয়ে। এক মাসের এ কর্মপদ্ধতিতে থাকে পুরো বছরের রোগমুক্তির পাথেয়। এরপরেও পুরনো অভ্যাস ও সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেকেই বঞ্চিত হন রোজা রাখার পূর্ণ উপযোগিতা থেকে। দৈনন্দিন জীবনের বেশ কিছু অস্বাস্থ্যকর কার্যকলাপে বছরের সাধারণ দিনগুলোতেই দেহ অরক্ষিত হয়ে থাকে। সেখানে টানা এক মাস দিনের একটা বিরাট সময় অনাহারে থাকা আরো কঠিন। আর এখানেই রোজা পালনে শারীরিক যোগ্যতার প্রশ্ন আসে। তাই চলুন, রোজা রাখার সময় শারীরিক সুস্থতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী দশটি বিষয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
রমজান মাসে সুস্থভাবে রোজা রাখতে যে দশ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি
.
সেহরি বা ইফতারে অতিরিক্ত খাওয়া: পুরো দিন অনাহারে থাকার পর সন্ধ্যায় রোজা ভাঙার মুহুর্তে স্বভাবতই পেট পূর্তির প্রতি একটু বেশিই আকুলতা কাজ করে। এ সহজাত প্রবৃত্তির তাড়ণায় সাড়া দিয়ে অনেকেই ইফতারে মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন। এ রকম অনিয়ন্ত্রিত আহার বদহজম এবং ওজন বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দেয়। এ সময় অনেকের মধ্যে এক বসাতেই সব খাবার গোগ্রাসে গেলার প্রবণতা দেখা যায়, যা আরো বেশি ক্ষতিকর। এর ফলে, খাবার হজমে দেরি হয় ও বিপাক ক্রিয়ার কার্যক্ষমতা কমে যায়। এর বদলে পানি দিয়ে রোজা ভেঙে মাগরিব নামাজ পড়ে তারপর আবার খেতে বসা উত্তম। এতে করে পরিপাক তন্ত্রের খাবার হজমকারী এনজাইমগুলো প্রস্তুত হওয়ার সময় পায়। পেট পূর্তির এ সমস্যাটি সেহরির ক্ষেত্রেও দেখা যায়। অনেকেই ভেবে থাকেন যে, রোজা শুরুর ঠিক আগ মুহুর্তে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করলে পরবর্তী দিনের বেলায় আর তৃষ্ণা লাগবে না। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ, এর ফলে পানি থেকে মুক্তি পেতে কিডনি দ্রুত সক্রিয় হয়ে যায়। ফলে, প্রস্রাব হয়ে যাওয়াতে এ অতিরিক্ত পানি পান কোন কাজেই লাগে না। বরং, দিনের বেলায় তৃষ্ণা লাগার ব্যাপারটি অব্যাহত থাকে।
ইফতারে তৈলাক্ত, অধিক চিনি ও লবণযুক্ত খাবার খাওয়া: সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, সেই মাত্রাতিরিক্ত খাবারের অধিকাংশই থাকে ভাজা-পোড়া কিংবা অধিক চিনি বা লবণযুক্ত। এছাড়া এগুলোতে, ক্যালোরির পরিমাণও থাকে বেশি। পুরো দিন উপবাসের পর এ খাবারগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই এক ভাল লাগা অনুভূতি দেয়। কিন্তু, অন্য দিকে পরের দিনের রোজা পালনটা কঠিন হয়ে ওঠে। মশলাদার ও অধিক লবণযুক্ত খাবার শরীরের পানির চাহিদা বৃদ্ধি করে। ফলে, তাৎক্ষণিকভাবে শরীরে অলসতা ও ক্লান্তির উদ্রেক ঘটে। নিয়মিত এ ধরনের খাদ্য গ্রহণে রক্তে শর্করার মাত্রায় ভারসাম্যহীনতা এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়।
সেহরির ব্যাপারে উদাসীনতা: বেশি রাত করে ঘুমাতে যেয়ে অনেকেরই সেহরির সময়টা বাদ পড়ে যায়। কেউ কেউ অগত্যা সেহরি ছাড়াই পরের দিনের রোজা অব্যাহত রাখেন। অনেকে আবার এ ঝামেলা এড়াতে ভোর রাতের বদলে রাত একটার মধ্যে সেহরি করে শুয়ে পড়েন। এ কার্যকলাপ শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে, পরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পালনের জন্য শরীর যথেষ্ট পুষ্টি ও শক্তি থেকে বঞ্চিত হয়। দিনের বেলা বিরামহীন পানিশূন্যতার মধ্য দিয়ে ক্লান্তি বোধ হয়। তদুপরি, সেহরি ও ইফতারে সল্পাহারের পরিবর্তে শুধু ইফতারে দুই বেলার খাবার একসাথে খেলে গ্যাস্ট্রিক ও ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি থাকে।
ক্যাফেইন গ্রহণ: কফি এবং চা-এ থাকা উত্তেজক পদার্থ ক্যাফেইনের মধ্যে রয়েছে মূত্রবর্ধক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ, প্রচুর পরিমাণে কফি বা চা পান মানেই প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। আর এভাবে ঘন ঘন প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর পানিশূন্যতার দিকে এগিয়ে যায়। তাই, রমজানের আগে থেকে কফি বা চা পানের অভ্যাসটি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
ঠান্ডা পানি বা কোমল পানীয় গ্রহণ: সেহরিতে সরাসরি ঠান্ডা পানি পান করলে পাকস্থলী ও অন্ত্রে রক্ত চলাচল কম হয়। এতে করে হজমের সমস্যা, স্থূলতা ও ঘন ঘন অ্যাসিডিটি হতে পারে। প্রক্রিয়াজাত কোমল পানীয় এমনিতেই অস্বাস্থ্যকর। সেখানে অত্যধিক ঠান্ডা হলে তা রোজার ক্ষেত্রে শরীরকে অত্যন্ত দুর্বল করে তোলে।
নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করা: দাঁত ব্রাশ করলে রোজা নষ্ট হয় না, যতক্ষণ না টুথপেস্ট গিলে ফেলা হয়। প্রায় সময় ব্রাশ করার পরে দাঁতের ফাঁকে অল্প টুথপেস্ট লেগে থাকে। এ কারণে সকালে ব্রাশ করা নিয়ে রোজা হওয়া না হওয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু, তাই বলে রমজানে দাঁত ব্রাশ করা থেকে বিরত থাকার কোন মানে হয় না। বরং, ব্রাশ না করার ফলে দাঁতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, ইফতার পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে এগুলো বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ফলে, মুখ গহ্বরে সৃষ্টি হওয়া অম্লত্ব দাঁতের ক্ষয় ঘটায়। তাই, সেহরির খাবার খাওয়ার পরে কিছু সময় রেখে ফজরের আযানের আগেই দাঁত ব্রাশ করে ফেলা যেতে পারে। এছাড়া, ইফতারের পরের সময়টাও দাঁত পরিষ্কারের জন্য উৎকৃষ্ট।
নিয়মিত গোসল না করা: গোসলের সময় নাক, কান বা মুখ দিয়ে শরীরের ভেতরে পানি ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে, রোজা নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে অনেকেই রমজান মাসে গোসল করা কমিয়ে দেন। কিন্তু, এটি কোন সঠিক সমাধান নয়। বরং, তা সর্বাঙ্গীনভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অন্তরায়। দিনের বেলা রোদের উষ্ণতার কারণে ত্বকের ছিদ্র দিয়ে তরল নিঃসরণ বেড়ে মুখ আর্দ্র হয়ে পড়ে। সেই সাথে শরীরের ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় পানির এক বিরাট অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রতিদিন গোসল করলে ত্বক এ তরল নিঃসরণ থেকে বিরত থাকে। এছাড়া, হাল্কা গরম পানিতে গোসল করা রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে শরীরকে শিথিলতা দান করে। প্রসারিত রক্তনালী দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে সারা দেহে রক্তের পরিচলন ঘটে। একই সময় ত্বকের ছিদ্রপথগুলোতে গোসলের পানি সহজে ঢুকে গিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে পারে। এতে করে শরীরের চামড়া ভাল থাকে, একই সাথে শরীরের ব্যথা ও ফোলাভাব দূর হয়। এছাড়া, নিয়মিত গোসল শরীরের বিভিন্ন অংশে জমে থাকা লবণ ধুয়ে ফেলে শরীরকে দুর্গন্ধ মুক্ত করে। সেহরির পূর্বে কুসুম গরম পানিতে গোসল করা শরীরের পেশী এবং জয়েন্টের ব্যথা উপশমে বেশ উপকারি। এ উষ্ণ স্নান শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে শরীরের বিপাককে সক্রিয় করে তোলে। এ সময় ক্যালোরি শোষিত হয়ে শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আর এ শক্তি উপবাসের সময় দীর্ঘ সময়ের জন্য পাকস্থলি পূর্ণ থাকার অনুভূতি দেয়।
দিনের বেলা অতিরিক্ত পরিশ্রম: পরিবেশ দূষণের কারণে উৎপন্ন তাপ সূর্যের তাপকে শরীরের জন্য অধিক বিপজ্জনক করে তোলে। এ অবস্থায় অনেককেই জীবিকার তাগিদে অধিকাংশ সময় রোদের মধ্যে ঘুরতে হয়। বিশেষ করে দুপুরের সূর্যের তাপ মাত্রাতিরিক্ত পানিশূন্যতাই সৃষ্টির মাধ্যমে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ধ্বংস করে। এ অবস্থায় আহার নিদেনপক্ষে পানি থেকে বিরত থাকা বেশ কষ্টকর। তাই, রোজা পালনের জন্য যতটুকু সম্ভব সূর্যের তাপ থেকে শরীরকে বাঁচিয়ে চলা উচিৎ। যাদের সকালে ব্যায়ামের অভ্যাস আছে, তারা সময়টা বদলে ইফতারের পরে ব্যায়াম করতে পারেন।
দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে বা বসে থাকা: রমজান মাসে রোজা রাখার অজুহাতে অনেকেই দীর্ঘক্ষণ যাবৎ অযথা অলস সময় কাটান। এটি শুধু সময় অপচয় নয়, বরং শরীরের উপরও এর ক্ষতিকর প্রভাব আছে। এমনকি যারা অফিসে বা বাসায় দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে কাজ করেন, বিষয়টি তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকার ফলে পা ও নিতম্বের পেশী দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এ পেশীগুলো মূলত হাঁটা ও স্থির হয়ে দাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, বিরামহীন বসে থাকা কোমড়ের ফ্লেক্সর পেশীগুলোকে ছোট করে দেয়। ফলে, এগুলোর সঙ্গে নিতম্বের জয়েন্টগুলোর অসঙ্গতি তৈরি হয়। এ পেশীগুলো দুর্বল হয়ে গেলে সামান্য হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরেও গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বসে বসে অনেক সময় পার করলে হজম প্রক্রিয়া কার্যকর থাকে না। ফলে, খাওয়ার সময় শরীরে প্রবেশকৃত চর্বি ও শর্করা শুধুমাত্র চর্বি হিসাবেই জমা হতে থাকে। এ ব্যাপারটি এমনকি বসে বসে অনেক ক্ষণ ধরে ব্যায়াম করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকার ফলে পিঠের সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে বসার ভঙ্গিটা যদি দুর্বল হয়। দুর্বল অঙ্গবিন্যাস মেরুদণ্ডের চাকতিগুলোকে সংকুচিত করে দিতে পারে। চরম অবস্থায় এটি মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়া ভাঙনের দিকে পরিচালিত করে, যা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে থাকার ফলে শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। খুব বেশিক্ষণ বসে থাকার ফলে পায়ের শিরাগুলোতে রক্ত প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। মেডিকেলের পরিভাষায় এ সমস্যার নাম ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (ডিভিটি)। এর ফলে ফুসফুসসহ শরীরের অন্যান্য অংশে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ঘুমে অনিয়ম: প্রতিদিন ঘুম কমবেশি হওয়া রোজা রাখার ক্ষেত্রে শারীরিক যোগ্যতা নষ্ট করে। ঘুম কম হলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে, স্থূলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মত স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি থাকে। ক্লান্তি ও দুর্বলতার একটি বড় কারণ হচ্ছে ঘুমের ধরনে পরিবর্তন। বিশেষ করে ইফতারের পর ভরা পেট নিয়ে ঘুমানো স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। এটি পরিপাকতন্ত্রের কাজকে বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে শরীরে চর্বি জমে ওজন বৃদ্ধি পায়।
রোজায় শরীর সুস্থ রাখতে এ দশ বিষয় এড়িয়ে চলা কেবল সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাই দেয় না, বরং উপকৃত করে ধর্মীয় দিক থেকেও। তৈলাক্ত, অধিক চিনি বা লবণযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা পানীয় পরিত্যাগে মুক্তি মিলে খাবারের দুশ্চিন্তা থেকে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায়ে নিয়মিত দাঁত ব্রাশ ও গোসলের কোন বিকল্প নেই। সর্বপরি, এগুলোর সাথে যুগপৎভাবে ঘুম ও শরীর চর্চার সুসঙ্গতিতে পাওয়া যেতে পারে একটি স্বাস্থ্যকর রমজান মাস।