ইউসুফ ইকবাল: নাট্যকলায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা ২০২৩ লাভ করায় চট্টগ্রামের বিশিষ্ট মঞ্চাভিনেত্রী শুভ্রা বিশ্বাসকে হার্দ্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। অভিনয় সৃজনশীল শিল্পকর্ম। অন্যের আবেগ আচরণ আভরণ ধারণ করে নিজেকে ভিন্ন চরিত্রে রূপায়ন করার দুঃসাধ্য সাধন করেন অভিনয়শিল্পী। এর জন্য প্রয়োজন শিল্পীর একাধিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সম্মিলন। শুভ্রা বিশ্বাস স্বকীয় প্রচেষ্টা গুণে এ দুঃসাধ্য শিল্পকর্মের একজন পারঙ্গম ও পরীক্ষিত প্রতিভা হিসাবে চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে পরিচিত। অভিনয়শিল্পী হিসাবে তিনি এতই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন যে, চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সবাই স্বতঃস্ফুর্তভাবে তার নামের সঙ্গে ‘অভিনেত্রী’ শব্দটি শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করে।
বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শুভ্রা বিশ্বাস অভিনয়ের চারুকর্মে নিবেদিত থেকে বহু বিচিত্র চরিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। দেশীয় প্রেক্ষাপটে রচিত মৌলিক নাটকের নাগরিক বা গ্রামীণ চরিত্র, দ্রোহী বা নির্যাতিতা নারী, বীরাঙ্গনা কিংবা বিদেশি বিবিধ চরিত্র রূপায়নে তিনি সমান পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। এ ক্ষেত্রে, তিনি বহু সময় নিজ দলের সীমা অতিক্রম করে যুক্ত হয়েছেন অন্য দলে বা সমন্বিত উদ্যোগে। একক বা দলীয়ভাবে- প্রসেনিয়াম থেকে খোলা মঞ্চে, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে, দেশ থেকে দেশের বাইরে নানা আয়োজনে তিনি অভিনয় করেছেন। ফলে, দীর্ঘ দিন ধরে তিলে তিলে বিপুল মঞ্চ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে অভিনয়শিল্পী হিসাবে তিনি অসামান্য উচ্চতায় উপনীত হয়েছেন।
শুভ্রা বিশ্বাসের অভিনয়ের বড় সম্পদ শিল্পিত কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গি। তার উচ্চারণ প্রমিত- কিন্তু চরিত্রের প্রয়োজনে তাতে যুক্ত করেন প্রয়োজনীয় স্বর ও সুর। ফলে, নাটকীয়গুণ ও শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত হয়ে ওঠে তার উচ্চারিত সংলাপ। সংলাপের বক্তব্য, রস ও ভাব অনুসারে কণ্ঠের যৌক্তিক ওঠানামার মধ্য দিয়ে তিনি চরিত্রের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও আবেগীয় স্তরকে অসাধারণ নৈপূন্যে তুলে ধরেন। মঞ্চের আলো, আবহ ও মঞ্চসজ্জা সহযোগে সৃষ্ট নাটকীয় বাস্তবতায় তখন চরিত্রটি দর্শকের সম্মুখে সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আঙ্গিক অভিনয়েও তিনি সাবলিল। বিভিন্ন বয়সের, সামাজিক বিভিন্ন স্তরের, দেশি বিদেশি নানা চরিত্রে তিনি নিজেকে মানিয়ে নেন অনন্য অভিনয় শৈলিগুণে।
শুভ্রা বিশ্বাসের অভিনয়চর্চার ক্ষেত্র মূলত চট্টগ্রাম ও তা প্রধানত মঞ্চের মধ্যে সীমাবদ্ধ। চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার বন্ধুর ভূমিতে এ অভিনয়শিল্পী অজস্র প্রতিকূলতাকে সাথী করে নাটকে নিবেদিত হয়েছেন। ৭০ দশকে নাট্যচর্চার উন্মেষকালে নাটকে নারীর অংশগ্রহণ সহজ ছিল না। কালের বর্তমান প্রান্তেও এ পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। নাটকে নারীর অংশগ্রহণে আবহমান কাল ধরে চলে আসা নেতিবাচক মনোভঙ্গির মাঝে থেকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে তাকে অভিনয়শিল্প চর্চা করতে হয়েছে। অজস্র প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে, আত্মত্যাগের মহিমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ৪০ বছরের অভিনয় জীবনের প্রান্তে এসে তিনি এখন নবীন নারী নাট্যকর্মীদের জন্য অনুকরণীয় আইকনিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
নাটকের অদেখা চরিত্রকে মঞ্চের বাস্তবতায় রূপায়িত করতে হলে সমাজ ও মানুষকে দেখার কিংবা অনুধাবন করার যে বিপুল জীবনাভিজ্ঞতা দরকার তার পর্যাপ্ত সঞ্চয় রয়েছে তার। অভিনয়ের জগতে নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে তার শিল্পীজীবন। ৭৮-এ অঙ্গনের হাত ধরে তিনি নিয়মিত হয়েছেন অভিনয়ে। ৮২-তে বহুমাত্রিক শিল্পী শান্তনু বিশ্বাসের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছেন কালপুরুষ। বর্তমানে তিনি এ দলের বিভিন্ন নাটকে অভিনয় ছাড়াও দলের প্রধান সংগঠক ও নির্দেশকের ভূমিকাও পালন করেন।
স্থানিক ও মাধ্যমগত কারণে এ সংগ্রামী শিল্পীর অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনের কথা জাতীয় প্রচার ও পরিচিতির মাধ্যমগুলোর দৃষ্টি সব সময় এড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া প্রান্তের প্রতি রাজধানীর উন্নাসিকতা ও অন্ধ কেন্দ্রপ্রীতির কারণে চট্টগ্রামের শিল্পীরা সব সময় জাতীয় স্বীকৃতিবঞ্চিত থেকেছেন। তা না হলে শুভ্রা বিশ্বাসের মত পরিচ্ছন্ন সাংস্কৃতিক বোধসম্পন্ন একজন সুদক্ষ অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে চট্টগ্রামসহ পুরো বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন বহু বেশি গর্ববোধ করতে পারত। আমি শুভ্রা বিশ্বাসসহ চট্টগ্রামের সব গুণীশিল্পীর যথাযথ জাতীয় স্বীকৃতি দাবি করছি।
লেখক: চট্টগ্রাম।