মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

শেষ বেলায় বাইডেনের বড় সিদ্ধান্ত, ‌‘এটিএসিএমএস’ কী ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেবে?

সোমবার, নভেম্বর ১৮, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বারের মত রাশিয়ার অভ্যন্তরে আঘাত হানতে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। বিদায়ী বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে বলেছে, ‘তারা রাশিয়ার অভ্যন্তরে সীমিত হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (আর্মি ট্রাকটিক্যাল মিশাইল- এটিএসিএমএস) ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত যুদ্ধে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে। সংবাদ বিবিসির।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দীর্ঘ দিন ধরে এ ধরনের হামলার অনুমতি চেয়ে এলেও যুক্তরাষ্ট্র তা অস্বীকার করে আসছিল। কারণ, তাদের ভয় করছিল যে, এর ফলে যুদ্ধ আরো বিস্তৃত হবে। কিন্তু, নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাত্র দুই মাস পূর্বে জো বাইডেন তার নীতিতে বড় পরিবর্তন আনলেন।

কেন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ভেতরে ‌‌‌‘এটিএসিএমএস’ ব্যবহারের অনুমতি দিল: ইউক্রেন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে রাশিয়ান সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার করছে; যা সাধারণত এটিএসিএমএস নামে পরিচিত। তারা মূলত ক্রিমিয়ান উপদ্বীপে রাশিয়ার বিমানঘাঁটি ও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলে সামরিক অবস্থানে হামলার জন্য এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কিয়েভকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের তৈরি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে দেয়া সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম; যা ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল) দূরের লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। ইউক্রেন যুক্তি দিয়ে আসছিল, রাশিয়ার অভ্যন্তরে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি না দেয়ার মানে পিঠের পিছনে এক হাত বেঁধে যুদ্ধ করতে বলা। গেল আগস্ট থেকে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলের এক হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি ভূখণ্ড দখলে রেখেছে ইউক্রেন। সেখানে সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার সৈন্য মোতায়েনের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের এত দিনের নীতিতে পরিবর্তন আনল। যদিও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের এ অনুমতির ব্যাপারটি নিশ্চিত করেননি। তবে রোববার (১৭ নভেম্বর) তিনি বলেছেন, ‘কথা দিয়ে হামলা হয় না… মিসাইল নিজেদের পক্ষে কথা বলবে।’

‘এটিএসিএমএস’ যুদ্ধে কী প্রভাব ফেলবে: এ ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধা দেবে। তারা সম্ভবত প্রথমে কুরস্ক অঞ্চলের চারপাশে আক্রমণ করবে এটা দিয়ে। ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, রাশিয়া ও উত্তর কোরীয়ার সেনারা কুরস্ক থেকে ইউক্রেনীয়দের তাড়িয়ে দিতে বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণ চালাবে। সেই হামলার কার্যকারিতা কমানোর জন্য রক্ষার জন্য সামরিক ঘাঁটি, অবকাঠামো ও গোলাবারুদের গুদামসহ রাশিয়ান অবস্থানগুলিকে লক্ষ্য করে এটিএসিএমএস হামলা চালাতে পারে ইউক্রেন।

তবে, ইউক্রেনের কাছে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র যে সরবরাহ তা সম্ভবত যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে না। রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জাম যেমন ফাইটার জেট, এরই মধ্যে আরো এয়ারফিল্ডে স্থানান্তরিত হয়েছে। কারণ, রাশিয়াও ধারণা করছিলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ আসতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ইউক্রেনের একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, ‌‘আমি মনে করি না এটি চূড়ান্ত কোন ফলাফল এনে দিবে।’

তবে, এটি ইউক্রেনের প্রতি অংশীদারিত্ব বাড়ানো ও সামরিক সমর্থন প্রদর্শনের জন্য একটি প্রতীকী সিদ্ধান্ত।

‘এটি রাশিয়ার যুদ্ধের ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে।’

ওবামা প্রশাসনে উপ-সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করা ইভলিন ফারকাস বলেছেন, ‘কী পরিমাণ মিসাইল সরবরাহ করা হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’

‌‘প্রশ্ন হল, তাদের কাছে কয়টি ক্ষেপণাস্ত্র আছে? আমরা শুনেছি, পেন্টাগন সতর্ক করেছে যে, তারা যে পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে দিতে চায় তার অনেকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই নেই।’

ফারকাসের মতে, এটিএসিএমএস ইউক্রেনের মাঝে ‘ইতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব’ ফেলতে পারে, যদি তারা এটি দিয়ে কার্চ ব্রিজের মতো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এ কার্চ ব্রিজ ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করেছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের এ অনুমতি আরেকটি প্রভাব দেখা যেতে পারে। তা হল রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার জন্য স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনকে অনুমতি দেয়ার জন্য যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে উৎসাহিত করতে পারে। স্টর্ম শ্যাডো একটি ফ্রাঙ্কো-ব্রিটিশ দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র; যা মার্কিন এটিএসিএমএসের মতই ক্ষমতাসম্পন্ন।

এটা কি সংঘাত আরো বাড়িয় দিবে: সংঘাত বেড়ে যাবে- এমন ভয় থেকেই বাইডেন প্রশাসন কয়েক মাস ধরে রাশিয়াকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত করার জন্য ইউক্রেনকে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করে আসছিল। ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়াকে আঘাত করার জন্য পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছেন, ‘মস্কো এটিকে ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটো দেশগুলির ‘সরাসরি অংশগ্রহণ’ হিসাবে দেখবে।’ গেল সেপ্টেম্বরে পুতিন বলেছিলেন, ‘এটি (রাশিয়ার অভ্যন্তরে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি), সংঘাতের প্রকৃতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করবে। এর অর্থ হবে ন্যাটো দেশগুলি; যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।’ রাশিয়া এর পূর্বেও ইউক্রেনকে আধুনিক যুদ্ধ ট্যাংক ও ফাইটার জেট দেয়ার ব্যাপারে এমন ‘রেড লাইন’ টেনে দিয়েছিল। কিন্তু, সেসব রেডলাইন অতিক্রম করেও রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধ এড়াতে পেরেছে ইউক্রেন। ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত কার্ট ভলকার বলেছেন, ‘ইউক্রেনের মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের পরিসর সীমিত করে, যুক্তরাষ্ট্র অযৌক্তিকভাবে ইউক্রেনের আত্মরক্ষায় একতরফা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।’ তিনি যোগ করেন, এটিএসিএমএসের ব্যবহার সীমিত করার সিদ্ধান্ত ‘সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী ও রাশিয়াকে উস্কানি দেয়ার ভয়ে করা হয়েছিল।’ ‘তবে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা একটি ভুল, কারণ এটি রাশিয়াকে সম্ভাব্য ইউক্রেনের হামলার আগাম বিজ্ঞপ্তি দেয়।’

ডোনাল্ড ট্রাম্প কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন: বাইডেন এ মুহূর্তে একজন ‘খোঁড়া-হাঁস’ রাষ্ট্রপতি; যিনি মাত্র দুই মাস পরই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। বাইডেনের এ নীতি ট্রাম্প অব্যাহত রাখবেন কি না নির্বাচিত হওয়ার পর তা এখনো স্পষ্ট করেননি। তবে, তার কিছু ঘনিষ্ঠ মিত্র এরই মধ্যে ইউক্রেনে বাইডেনের নীতির সমালোচনা করেছেন। ট্রাম্পের ছেলে, ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, মনে হচ্ছে, আমার পিতার শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ও জীবন বাঁচানোর সুযোগ পাওয়ার পূর্বেই তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু করবে সামরিক শিল্প।’ ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে কী নীতি গ্রহণ করবেন তা সম্ভবত তৈরি করেননি। যদিও তিনি এক দিনের মধ্যে সংঘাত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তা কীভাবে করবেন তা কখনই স্পষ্ট করেননি। ট্রাম্পের বিরোধীরাও তাকে পুতিনের সহানুভূতিশীল বলে অভিযোগ করেন। কারণ, ট্রাম্প বহু বার পুতিনের প্রশংসা করেছেন। ট্রাম্পের বহু শীর্ষ কর্মকর্তা, যেমন রানিংমেট (ভাইস-প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত) জেডি ভ্যান্স বলেছেন, ‌‘ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোন সামরিক সহায়তা দেয়া উচিত নয়।’ কিন্তু, পরবর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের কেউ কেউ ভিন্ন মতও পোষণ করেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজ যুক্তি দিয়েছেন, রাশিয়াকে আলোচনায় বাধ্য করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ ত্বরান্বিত করতে পারে। যদিও ইউক্রেনের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ট্রাম্প ইউক্রেনে এটিএসিএমএসসহ অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন। ‌‘আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করি, (ট্রাম্প) বাইডেনের (সিদ্ধান্ত) ফিরিয়ে নেবেন না।’ বলেছেন ইউক্রেনের সাংসদ ওলেক্সি গনচারেঙ্কো।