শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

শিরোনাম

এভাবে চলতে থাকলে দারিদ্র্য আরো বাড়বে

রবিবার, আগস্ট ১৪, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ডেস্ক রিপোর্ট: নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্যের সঙ্গে আর পেরে উঠছে না সাধারণ মানুষ। কম খেয়ে, এক বেলা না খেয়ে অথবা ঋণ করে চলছেন তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে দারিদ্র্য আরো বাড়বে। তাদের কথা, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় নতুন করে তৃতীয় দফায় নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার ঢেউ চলছে। গত কয়েক দিনে সব পণ্যের দাম গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ বেড়েছে। খবর ডয়চে ভেলের।

প্রতিনিয়ত দাম বাড়ছে: এখন প্রতিদিনই পণ্যের দাম বাড়ছে। ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন তিন দিনের ব্যবধানে এখন ১৫০-১৫৫ টাকা। তিন দিন আগে ছিল ১২৫ টাকা। প্রতিটি ডিমের দাম এখন ১৩ টাকারও বেশি।

কলাবাগানের মুদি দোকানদার মিন্টু মিয়া জানান, হয়তো দুয়েক দিনের মধ্যে একটি ডিমের দাম ১৫ টাকা হবে। এখন সবচেয়ে কম দামের স্বর্ণা মোটা চালের দামও ৫৩-৫৫ টাকা। এর চেয়ে কমদামে বাজারে আর কোন চাল নেই। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে কোথাও কোথাও ২০ টাকা বেড়ে গেছে। সরকারের বেঁধে দেয়া ১৮৫ টাকা দামে আর সয়াবিন তেল পাওয়া যায় না। চাল, ডাল, চিনি, দুধ সব পণ্যের দামই গত দুই-তিন দিনে কেজিতে পাঁচ থেকে দশ টাকা করে বেড়েছে।

এ দিকে, ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা। তাই বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। তারা দাম শতকরা ২০ ভাগ বাড়ানোর দাবি করেছেন। কাঁচাবাজারেরও একই অবস্থা। ১২০ টাকা কেজির শিম বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, ৭০ টাকার গাজর ১২০ টাকায়। টমেটোর দাম কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিতে শাকসবজির দাম বেড়েছে দশ থেকে ৪০ টাকা।

যেভাবে চলছে মানুষ: একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এসএম আলমগীর হোসেন শুক্রবার (১২ আগস্ট) সকালে বাজারে গিয়ে অনেকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তিনি তার সব পণ্যই আগের চেয়ে পরিমাণে কম কিনতে বাধ্য হন। ৫০ হাজার টাকা বেতনের এ চাকুরে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে কীভাবে টিকে থাকবেন তা ভাবতে পারছেন না। গত তিন বছরে তার বেতন বাড়ে নি৷ তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে ঢেঁড়সের কেজি আমি কিনেছি ৫০-৫৫ টাকায়, আজকে (শুক্রবার) সকালে বাজারে গিয়ে দেখি দাম ৬০-৭০ টাকা। শসা কেজিতে দশ টাকা বেড়েছে। টমোটের কেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সব ধরনের মাছের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। গরুর মাংস, মুরগির মাংসের দাম বেড়েছে। পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের দাম বোতলের গায়ে লেখা আছে ৯১০ টাকা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৯৯৭ টাকায়। ১০০ টাকা বেড়ে গেছে।’

আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমাকে ব্যয় কমাতে হচ্ছে। যেমন আগে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার আমাদের পরিবারে আমরা গরুর মাংস খেতাম। এখন দুই সপ্তাহে এক বার খাই। মুরগির মাংস সপ্তাহে তিন দিন খেতাম, এখন খাই এক দিন। মাছ খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি। এখন বাচ্চাদের জন্য দুধ কেনাসহ সব কিছুই আগের চেয়ে কম কিনছি।’

স্কুল শিক্ষিকা সুমাইয়া করিম বলেন, ‘সংসারের খরচ মেটাতে এত দিন ঋণ করেছি। বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার নেয়া ছাড়াও বেতনের বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ করেছি করোনার সময়। আশা করেছিলাম, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শোধ করতে পারব। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। সব কিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। এখন আমি পড়েছি মহাবিপদে। ঋণও শোধ করতে পারছি না। ধার দেনা করার আর কোন জায়গাও নেই। কী করব আর ভেবে পাচ্ছি না।’

কতটা দাম বেড়েছে, মানুষ টিকে আছে যেভাবে: কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর এ কয়েক দিনে প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গড়ে শতকরা ৩০ ভাগ বেড়েছে। আর এটা সাধারণ মানুষকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলেছে। মানুষ কম খেয়ে অথবা এক বেলা না খেয়ে টিকে আছে। আবার এখন যে ঋণ করে সামাল দেবে তাও পাওয়া যাচ্ছে না।’

তার কথা, ‘জ্বালানি তেলের দামের কারণে সব কিছুর দামই বাড়ছে। কিন্তু যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি বাড়ছে। সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই সুযোগ নিচ্ছে, সবজি দোকানদার থেকে শুরু করে সবাই। চাল আমদানির সুযোগ দেয়ার পরও চালের বাজারে সংকট তৈরি করা হয়েছে চাল মজুদ করে। ভোজ্য তেলেও তাই করা হচ্ছে। বাজার মনিটরিং বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না।’

দারিদ্র্য বাড়বে: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দামের সাথে যে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে, তা অতিরিক্ত। ফলে এর প্রভাব সবখানে পড়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ কৃষিপণ্যের দাম বাড়ছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্ব পরিস্থিতি যা, সেই তুলনায় বাংলাদেশে বেশি দাম বাড়ছে। কারণ এখানে বাজারে তেমন মনিটরিং নেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন মালিকরা ইচ্ছে মত ভাড়া বাড়িয়েছেন। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পরিস্থিতি এত খারাপ হত না।’

তার কথা, ‘গত এক, দেড় বছরে এটা তৃতীয় দফায় মূল্য বৃদ্ধির ঢেউ। এ সময়ে গড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর প্রভাবে দারিদ্র্য আরো বাড়বে।’

মোয়াজ্জেম মনে করেন, জ্বালানি তেলের এভাবে নজিরবিহীন দাম বাড়ানো কোনভাবেই ঠিক হয় নি। এটা অন্যভাবেও ম্যানেজ করা যেত। এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হবে।’

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে করোনার কারণে তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। আর গত জুন মাসে পিপিআরসি ও ব্র্যাকের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নতুন করে আরো ২১ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন।’