রবিবার, ০৫ মে ২০২৪

শিরোনাম

লাইফস্টাইল/প্রচণ্ড গরমে পানিশূন্যতা প্রতিরোধে উপকারী শাকসবজি

বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

লাইফস্টাইল প্রতিবেদক: গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে মাত্রাতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীর আশঙ্কাজনক হারে পানি হারাতে শুরু করে। পরিণতিতে দেখা দেয় পানিশূন্যতা, যার দীর্ঘ স্থায়ীত্ব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। মানবদেহের এ ভারসাম্যহীনতা মাথা ঘোরা, ক্লান্তি ও শুষ্ক মুখমণ্ডলের মত উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে শুরু করে। এ অসহনীয় খরতাপের সময়টাকে মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে উচ্চ পানীয় উপাদান সমৃদ্ধ শাকসবজি। এ খাবারগুলো শরীরের হারানো পানি পুনরায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দেহের রোগমুক্তিতেও সাহায্য করে। চলুন, তীব্র গরমে পানিশূন্যতা দূর করতে সেই শাকসবজিগুলোর বিষয়ে জেনে নেয়া যাক।

শসা: প্রায় ৯৫ শতাংশ পানিতে পরিপূর্ণ শসা গরমের জন্য উপযোগী সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও, এতে থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে সহায়তা করে। শসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বিটা ক্যারোটিন। এ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো শরীরের ফ্রি র‍্যাডিকেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করে। ফ্রি র‍্যাডিকেল হল জোড়াহীন ইলেকট্রন, যা কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ও নানা ধরনের রোগের কারণ হতে পারে। রোদের তীব্র রশ্মির কারণে ত্বকে রোদে পোড়া ব্যথা, ফোলাভাব ও ত্বকের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থা থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় সাহায্য করতে পারে শসা। চোখের নিচে এক বা দুই টুকরো শসা রাখলে চোখের কালো দাগ ও ফোলাভাব কমে আসে।

টমেটো: নানা রকমের ভিটামিন ও পটাশিয়ামের আধার টমেটোতে পানির পরিমাণ প্রায় ৯৫ শতাংশ। লাইকোপিন নামের পদার্থ টমেটোর উজ্জ্বল লাল রঙের কারণ। শুধু তাই নয়, এ উপাদানের মধ্যে রয়েছে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্য। তাই, এ ফলের রয়েছে মানবদেহের কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা। এ একই কারণে টমেটো ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। লাইকোপিনের পাশাপাশি অন্যান্য উদ্ভিদ যৌগ রোদে পোড়া থেকে রক্ষার কাজে অংশ নেয়। স্মার্টফোন ও কম্পিউটারের মত ডিজিটাল ডিভাইস থেকে এক ধরনের নীল আলো নির্গত হয়, যা চোখের জন্য ক্ষতিকর। টমেটোতে থাকা লুটেইন এবং জিক্সানথিন নামের পদার্থ এ নীল আলোর বিরুদ্ধে চোখের সুরক্ষায় কাজে লাগে। উপরন্তু, এগুলো চোখের ক্লান্তি ও চোখের উপর চাপ জনিত কারণে মাথাব্যথা উপশমে সাহায্য করতে পারে।

পালং শাক: তাজা, হিমায়িত, বাষ্প বা দ্রুত সিদ্ধ যে কোন অবস্থায়ই পালং শাক বেশ পুষ্টিকর একটি খাদ্য। কাঁচা পালং শাকে রয়েছে ৯১ শতাংশ পানি, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন ও ফোলেট। এ শাকে থাকা লুটিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বার্ধক্যজনিত কারণে চোখের রোগ ও ছানি পড়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া, লুটেইন চোখের লেন্সের উপর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধ করতে সক্ষম। শরীরের ত্বকসহ বিভিন্ন রকমের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের টিস্যু বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন এ অপরিহার্য, যা পালং শাকের অন্যতম উপাদান। শুধু তাই নয়, ভিটামিন এ ত্বকের পানিশূন্যতা দূর করতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর ফলে, মুখে সূক্ষ্ম রেখা ও বলিরেখা কমে যায়।

মূলা: মাঝারি পরিমাণ ভিটামিন সি সম্পন্ন কাঁচা মূলায় পানির অংশ ৯৫ শতাংশ। তবে, এর পাতায় থাকে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড। শিকড়ের চেয়ে পাতায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি। এ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাটিচিন, পাইরোগালল, ভ্যানিলিক অ্যাসিড এবং অন্যান্য ফেনোলিক যৌগ। এগুলো সম্মিলিতভাবে ক্যান্সারসহ নানা রোগের বিরুদ্ধে শরীরকে রীতিমত একটি প্রতিরক্ষা দূর্গে পরিণত করে। এছাড়াও, মূলায় রয়েছে কিডনি বিশোধনের ক্ষমতা। এটি পাকস্থলির নানা এনজাইমকে সক্রিয়করণে সাহায্য করে। এ এনজাইমগুলো বিভিন্ন ধরনের বিষক্রিয়া থেকে কিডনিসহ আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাকে মুক্ত রাখে।

ফুলকপি: ৯২ শতাংশ পানি সম্পন্ন এ মৌসুমি সবজিটি সুপার ফুড নামে পরিচিত। শরীরের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এ সবজি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ক্রুসিফেরাস সবজি হিসেবে ফুলকপি ফাইবারের একটি চমৎকার উৎস। ফাইবার স্বাস্থ্যকর হজম বজায় রেখে নানা হজমজনিত রোগের ঝুঁকি হৃাস করে। ফুলকপিতে থাকা উপাদানগুলো অন্ত্রে উপকারি ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে অংশ নেয়। এ ব্যাকটেরিয়াগুলোর কারণে শরীরের প্রদাহ, হৃদরোগ, ডিমেনশিয়া ও স্থূলতার ঝুঁকি কমে। ফুলকপি হল কোলিনের অন্যতম সেরা উৎস। মেজাজ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতিশক্তি ও পেশী নিয়ন্ত্রণসহ বহু স্বাস্থ্যকর স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপের জন্য কোলিন অপরিহার্য। শরীরে অভ্যন্তরে এ পুষ্টির ঢুকার সাথে সাথে বয়স-সম্পর্কিত জ্ঞানীয় রোগ, কিডনির সমস্যা ও হৃদ রোগের ঝুঁকি কমতে থাকে।

গাজর: ভিটামিন এ সমৃদ্ধ গাজরে প্রায় ৮৬-৯৫ শতাংশ পানি থাকে। গাজরের বিটা ক্যারোটিন নামের রঞ্জকটি মূলত শরীরের অভ্যন্তরে ভিটামিন এ-তে পরিবর্তিত হয়। স্বাস্থ্যকর ত্বক বজায় রাখার জন্য বহুল পরিচিত পুষ্টিগুণ ভিটামিন এ। চামড়ার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে বিটা ক্যারোটিন ত্বককে রোদে পোড়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া, স্থূলতা, পানিশূন্যতা, বার্ধক্য জনিত বলিরেখাসহ বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে গাজরের অবদান অপরিসীম। গাজরে থাকা ভিটামিন সি শরীরকে কোলাজেন তৈরি করতে সহায়তা করে। কোলাজেন এমন একটি প্রোটিন যা ত্বকের গঠন, স্থিতিস্থাপকতা, শক্তি ও কোষের পুনঃবৃদ্ধিতে অংশ নেয়। এছাড়া, এর সূর্যের অতি-বেগুনি রশ্মি থেকে ত্বককে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রয়েছে।

পুদিনাপাতা: ভিটামিন এ এবং সি এর পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন ও ফসফরাসের একটি সমৃদ্ধ উৎস পুদিনাপাতা। সতেজ পুদিনা পাতায় পানির পরিমাণ ৮৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ সবজির রয়েছে হালকা অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট বৈশিষ্ট্য, যা ত্বকের সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি মৃত ত্বকের কোষগুলোকে পরিষ্কার করে ত্বককে যে কোন সংক্রমণ থেকে দূরে রাখে। এছাড়াও, পুদিনাপাতা ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে ও ত্বককে নরম রেখে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণ করে। এর ব্যাকটেরিয়া বিরোধী বৈশিষ্ট্য ত্বককে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে দূরে রাখে। ফলে, মুখে ব্রণ ওঠা ও কালো দাগ দেখা দেয়া ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে।

পেঁয়াজকলি: গ্রীষ্মের খরতাপে শরীরের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটানোর উৎকৃষ্ট সবজি পেঁয়াজকলি, যার প্রায় ৮৯ ভাগ পানি। এতে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড স্বাস্থ্যকর ত্বকের কোষ তৈরি করতে সাহায্য করে। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে ত্বকে যে কোন লালভাব ও ফোলাভাব দমন হয়। পেঁয়াজকলিতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। এ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য ব্রণ, কালো দাগ ও ত্বকের জ্বালা কমাতে সহায়তা করে। ভিটামিন সি এর এ প্রাকৃতিক উৎস প্রদাহ-বিরোধী ক্ষমতার অধিকারী। এছাড়াও, এটি মলমূত্রতন্ত্রের স্বাস্থ্যকর কোষগুলোর অম্লত্ব দূরীকরণে অংশ নেয়। এর ফলে, শরীর থেকে বর্জ্য ও অপ্রয়োজনীয় খাদ্যের অবশিষ্টাংশগুলো সঠিকভাবে নির্মূল হয়।

ঢেঁড়শ: ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ কাঁচা ঢেঁড়শে পানির পরিমাণ ৯০ শতাংশ। এ সবজি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এতে থাকা পটাসিয়ামের রয়েছে শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা। শরীরের অভ্যন্তরে বিষক্রিয়া নির্মূলে ঢেঁড়শের পানি বেশ কার্যকরী। এর উচ্চ ফাইবার সামগ্রী অন্ত্রের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার সুবিধা দেয়। ফাইবার হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্যও বহু উপকারী। এছাড়াও, এটি পরিপাকতন্ত্রে কোলেস্টেরলের সাথে আবদ্ধ হয়ে রক্ত প্রবাহে কোলেস্টেরলের শোষণ প্রতিরোধ করে। এতে করে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে আসে।

লাউ: প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ আরো একটি সবজি লাউ, যার ৯৬ দশমিক এক শতাংশ পানি। পানিশূন্যতা নিরসণের পাশাপাশি এটি হজম ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ উপযোগী। লাউ একটি প্রাকৃতিক মূত্রবর্ধক। সেই সাথে মূত্রনালীর রোগের চিকিৎসায় লাউয়ের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এছাড়াও, কিডনির প্রদাহ নিরাময়, জন্ডিসের চিকিৎসা ও কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে লাউ বেশ কার্যকর। ভিটামিন সি এবং জিঙ্কের একটি ভাল উৎস হওয়ায় এ সবজি ত্বকের জন্য যথেষ্ট উপকারী। বিশেষ করে ভিটামিন সি অতিবেগুনি বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি থেকে ত্বককে রক্ষা করতে পারে। তাছাড়া, লাউ ত্বকের বার্ধক্যের লক্ষণগুলো দূর করতেও যথেষ্ট কার্যকর।

তীব্র গরমে শরীরে পানির ঘাটতি মেটাতে এ শাকসবজিগুলো সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিষেধক। তন্মধ্যে শসা, গাজর, টমেটো ও পুদিনাপাতা সব একত্র করে সালাদ তৈরি একই সাথে জনপ্রিয় ও স্বাস্থ্যকর। এ রকম নাস্তায় দারুণ সংযোজন হতে পারে মূলা ও ফুলকপি, যেগুলো আলাদাভাবে তরকারি হিসেবেও উপযোগী। সপ্তাহের খাদ্যতালিকায় পালা করে পালং শাক, পেঁয়াজকলি, লাউ ও ঢেঁড়শ রাখা হলে তা দীর্ঘ মেয়াদে একটি সুষম খাদ্যাভ্যাস গঠনে সহায়ক হতে পারে।