শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

শিরোনাম

সত‍্য ও সুন্দরের খোঁজে রণধীর দাশ হয়ে ওঠেন আত্মপ্রত‍্যয়ী শাস্ত্রীয় বংশীবাদক

বুধবার, মে ৩, ২০২৩

প্রিন্ট করুন
শ্রী রণধীর দাশ

মোহাম্মদ ওয়াসিম: কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব, কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব, ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি, যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।’ যন্ত্রসঙ্গীতের যে কয়টি যন্ত্র মানুষের অন্তরের ভাষা উপযোগী সুর সৃষ্টি করতে পারে, বাঁশী তার অন‍্যতম। বাঁশিতে এক অসাধারণ সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। সুরের অসাধারণ এ যন্ত্রটি দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দর্শক শ্রোতাদের অন্তরে মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে আছে। শাস্ত্রীয় বংশীবাদকে যে কয়জন সঙ্গীতগুণী মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে শ্রী রণধীর দাশ একজন। প্রচার বিমুখ একনিষ্ঠ এ শিল্পী চেষ্টা করছেন, রাগ সঙ্গীতের সুরে অবগাহন করতে। রণধীর দাশ কয়েক যুগ ধরে শুদ্ধ সঙ্গীতের সাধনায় নিমগ্ন।

কেবল প্রথাগত শিক্ষা নয়, আত্মানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে সুন্দর সৃষ্টিই তার সাধনা। অর্থ, প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রতিযোগিতার জন্য নয়, কেবল সঙ্গীতকে ভালবেসে তিনি শাস্ত্রীয় বংশী বাদনে জীবন সমর্পণ করেছেন। সত‍্য ও সুন্দরের খোঁজে রণধীর দাশ ক্রমে হয়ে ওঠেন এক আত্মপ্রত‍্যয়ী শাস্ত্রীয় বংশী বাদক। তার জীবন উৎসর্গীকৃত হয়েছে শিল্পের উৎকর্ষ লাভের আকাঙ্ক্ষায়। তার বাঁশির সুর মন্ত্র মুগ্ধের মত টানে মানুষকে। আর তাই তিনি নিভৃতে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বাঁশি প্রেমিকদের।

১৯৭০ সালের ২০ জুলাই রণধীর দাশ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার দক্ষিণ আমিরাবাদে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন। তার পুরো পরিবার‌ই সঙ্গীত অনুরাগী। বাবা স্বর্গীয় সুরেশ চন্দ্র দাশ ও মা স্বর্গীয় বালা কুমারী দাশ। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে বর্তমানে এনায়েত বাজার বাটালী রোডস্থ হোসেন বক্স ইন্ডাস্ট্রিজে ম‍্যানেজার হিসেবে নিয়োজিত আছেন।১৯৯০ সাল হতে রণধীর দাশ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তার জীবনের প্রথম বাঁশিতে হাতেখড়ি প্রয়াত সুলতান আহমেদের হাত ধরে। এর পরের শিক্ষা গুরু মৃণাল দাশ গুপ্ত ও মনিরুজ্জামান মনির কাছ থেকে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নানা দিক সম্পর্কে জানার জন্য তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ মিহির লালার কাছ থেকে। এছাড়াও, দেশের বাইরে এ উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তী পদ্মা-বিভুষণ পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার সান্নিধ্যে থেকে এখনও তালিম নিয়ে যাচ্ছেন।

রণধীর দাশ কৈশোর থেকে বাঁশির হৃদয় করা সুর তাকে দারুনভাবে কাছে টানত। সেই থেকে বাঁশি নিয়ে সুরের সাধনায় নিমগ্ন হলেন।সুর, তাল, ও নৃত্য- এ তিন কলার সমন্বিত রূপ হল সঙ্গীত। যারা বিভিন্ন যন্ত্র বাদনে দক্ষ তারা অনায়াসে তবলা ও বাজাতে পারেন; রণধীর দাশও এর ব‍্যতিত্রুম নয়। অনেক অনুষ্ঠানে তবলা বাজানোর সুযোগ হয়েছে তার। বংশীবাদক পরিচয়টি রণধীর দাশের কাছে যেমন গৌরবের, তবলা বাদকের পরিচয়টিও তেমনি উনার কাছে আনন্দের।

২০১০ হতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এবং এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম সঙ্গীত বিদ‍্যাপীঠ আর্য‍্য সংগীত সমিতিতে শাস্ত্রীয় বাঁশিতে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং এখনও পর্যন্ত শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও, বাংলাদেশ বেতারে বিশেষ গ্রেডে উচ্চাঙ্গ সংগীত বাঁশিতে ২০০০ হতে তালিকাভুক্ত হন। ২০১২ থেকে তালিকাভুক্ত হন বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রে বিশেষ গ্রেডে উচ্চাঙ্গসংগীত বাঁশিতে।

রণধীর দাশ মনে করেন, সুর হল গভীর ধ‍্যানের বিষয়, সুরের ধ‍্যানে গভীরভাবে নিমগ্ন না হলে সঙ্গীত সাধনা সফল হ‌ওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে বাঁশি শিক্ষার অভাব বেশ লক্ষণীয়। যদি কে শাস্ত্র শুদ্ধ ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা লাভ করে, কেউ যদি এর পেছনে লেগে থাকার ধৈর্য রাখে ও নিয়মিত চর্চা অব্যাহত রাখে, তাহলে তার সাধনা সফল হবেই। শুধুমাত্র সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেই আলোকিত মানুষ তৈরি করা সম্ভব। সব ধরনের অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার অন‍্যতম উপায় হল সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা, এর কোন বিকল্প নেই।’

রণধীর দাশ শাস্ত্রীয় সংগীত বাঁশির প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে বংশীধ্বনি নামে একটি নিজস্ব সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন এবং বংশী ধ্বনির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এখনো পর্যন্ত। এর মাধ্যমে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত বাঁশিতে ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে শিক্ষা দিয়ে থাকেন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বৃন্দ বংশীবাদন পরিবেশন করেন। এ বংশী ধ্বনির মাধ্যমে শত শত ছাত্র ছাত্রীর মাঝে শাস্ত্রীয় সংগীত বাঁশিতে তালিম দিয়ে যাচ্ছেন।

রণধীর দাশ বিভিন্ন সংগঠন থেকে তার অবদানের জন্য বিভিন্নভাবে সম্মাননা স্মারক পেয়েছে। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য সংগঠন হল- সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গসংগীত পরিষদ বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সনাতন ধর্ম পরিষদ, অদ্বৈত অচ‍্যুত মিশন বাংলাদেশ, আশাবরী সঙ্গীত নিকেতন, ভারতে পশ্চিম বঙ্গের প্রসাদপুর শ্রী রামকৃষ্ণ বাদান্তে কুটির। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন সংগঠনের আমন্ত্রণে শাস্ত্রীয় সংগীত বাঁশিতে পরিবেশন করে সর্ব মহলের কাছে সুপরিচিত অর্জন করেন। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য সংগঠনের উৎসব সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব, স্বরিৎ ললিতকলা উৎসব, আর্য সংগীতের শতবর্ষ উৎসব, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসব, বাংলাদেশ শিল্পকলা যন্ত্রসঙ্গীত উৎসব উদযাপন।

রণধীর দাশ উচ্চাঙ্গসংগীতে নিবেদিতপ্রাণ একজন আপাদমস্তক শিল্পী; যিনি এখনো প্রতিদিন নিয়মিত রে‌ওয়াজ ও ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে শাস্ত্রীয় সংগীত বাঁশিতে তালিম দিয়ে যাচ্ছেন। বাঁশী নিয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান। এ নিভৃতচারী শিল্পী যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন বাঁশি হাতে শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। রণধীর দাশের ইচ্ছে- দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করা।

রণধীর দাশ বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বংশীবাদক হিসেবে নিয়মিত অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের প্রচার বিমুখ একনিষ্ঠ শাস্ত্রীয় বংশীবাদক রণধীর দাশের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও সুন্দর জীবন কামনা করছি।

লেখক: বংশীবাদক ও সংস্কৃতিকর্মী, চট্টগ্রাম।