রবিবার, ০৫ মে ২০২৪

শিরোনাম

সায়মন রাশেদের ধারাবাহিক উপন্যাস: লাল নীল হলুদ ।। পর্ব দুই

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ১, ২০২৪

প্রিন্ট করুন
সায়মন রাশেদ

রাজু লোকটার দিকে এবার ভাল করে তাকাল।
লোকটার পড়নে নীল রঙের শার্ট আর কালো গাবাডিং প্যান্ট। খালি পা। লোকটার মুখে দুঃখের ছাপ নেই। তবে, চোখ জ্বলজ্বল করছে। হয়ত মেয়ের কথা মনে পড়ায় চোখে পানি চলে এসেছে।
লোকটা তার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটা লকেট বের করে আনল।
লম্বা সোনালি চেইনের মাঝে একটা চৌকোণা লাল পাথর বসানো লকেট। বেশ সুন্দর লকেটটা। লোকটার হাতে রাখা লকেটটার উপর জ্যোৎস্নার আলো পড়ায় সোনালি চেইনটা চকচক করছিল। আর তার লাল পাথরটা জ্যোৎস্নার আলোকে লাল উজ্জ্বলতায় পাল্টে দিচ্ছিল।
রাজু লকেটটা দেখে মুগ্ধ হয়।
রাজু বলল, ‘লকেটটা তো বেশ সুন্দর।’
লোকটা হেসে লকেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লকেটটা আমার মেয়ের।’
রাজু চুপ হয়ে গেল।
লোকটা বলতে লাগল, ‘আমার মেয়ের লাল রং অনেক পছন্দ। মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলাম ওকে। লকেটটা পেয়ে যে ও কি খশি হয়েছিল, তা বলে বোঝানো সম্ভব না। অনেক শখের লকেট ছিল এটা ওর। সারা দিন গলায় রেখে দিত। লকেটটা খুলতেই চাইত না গলা থেকে।’
কথা বলা শেষ করেই লোকটা হাসল।

রাজু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন, তবে কি জানতে পারি, আপনার মেয়ে কিভাবে মারা যায়?’
লোকটা লকেটটা হাতে মুঠ করে ধরে। একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে। তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘আমার মেয়েটার বই পড়ার শখ ছিল। আমি ওকে নানা ধরনের বই এনে দিতাম। ও প্রকৃতি বিষয়ক বইগুলো পছন্দ করত। ওর প্রকৃতির প্রতি একটা আলাদা টান ছিল। জ্যোৎস্না রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়লেও ও জানালার পাশে বসে চাঁদ দেখত। চাঁদ দেখতে নাকি অনেক ভাল লাগত ওর কাছে। মাঝে মাঝে চাঁদকে বিয়ে করতেও চাইত দুষ্টটা। আমিও বলতাম, তোকে চাঁদের সাথে বিয়ে দেব। এক দিন ভাবলাম ও যখন জ্যোৎস্নার জন্য এত পাগল, তাহলে ওকে নিয়ে এক দিন জ্যোৎস্না রাতে ঘুরে বেড়াব। তাই, এক দিন জ্যোৎস্না রাতে ওকে নিয়ে বের হই জ্যোৎস্না দেখব বলে। ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ি এ মাঠে। দেখলাম মাঠ থেকে জ্যোৎস্না দেখতে অপূর্ব লাগে। এরপর থেকে প্রায়ই জ্যোৎস্না রাতে আমরা এখানে আসতাম। বসে থাকতাম। গল্প করতাম। মাঝে মাঝে ও ঘুমিয়ে পড়লে ওকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। এমনই এক জ্যোৎস্না রাতে আমি আর আমার মেয়ে বসে আছি। মাঠের চারদিকে গাছপালা আছে। মাঠের এক কোণে একটি জবা ফুলের গাছ। ঐ যে ঐ গাছটা।’

লোকটা তার আঙুল দিয়ে মাঠের এক কোণের দিকে ইশারা করল। রাজু সেদিকে তাকাল। তাকিয়ে একটি জবা ফুলের গাছ দেখতে পেল। সে এর আগেও এ মাঠে এসেছে, কিন্তু গাছটা দেখেনি। হয়ত সেটা মাঠের এক কোণে তাই। আর রাজু জ্যোৎস্না রাত ছাড়া দিনের বেলা এ দিকে তেমন আসে না। এ জন্য হয়ত সে দেখেনি। মাঠের কোণে কে যে জবা ফুল গাছ লাগিয়েছিল কে জানে।

লোকটা আবার বলতে শুরু করল, ‘আমার মেয়ে ঐ জবা ফুল গাছটার একটা ফুল চেয়েছিল। আমি বললাম, মা শুধু শুধু গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ব? গাছটাকে কষ্ট দেয়া কি ঠিক হবে? ও বলল, গাছ কষ্ট পাবে না। আমরাই তো গাছটা লাগিয়েছি। আমি বললাম, আমরা লাগিয়েছি মানে? ও বলল, জবা ফুল এনে দেয়ার পর বলবে। ও কোন কথা শুনবে না, ওর একটা জবা ফুল চাই। তারপর আমি গেলাম একটা জবা ফুল আনতে। গাছটা তখন ছোট ছিল। বেশির ভাগ ফুলই তখনো ফুটে নি। শুধু একটাই জবা ফুল ফুটে ছিল। সেটাই গাছের ডাল থেকে তুলে নিলাম। এরপর আমি যখন মাঠের দিকে ফেরা শুরু করি, তখন দেখি আমার মেয়েটার পাশে কে যেন বসে আছে। আর আমার মেয়ে তার সাথে কথা বলছে। আমি ভাবলাম কে উনি? আমি দ্রুত পা চালাতে থাকলাম। আমি কাছে আগাতেই দেখলাম তিনি আমার মেয়েটাকে মেয়েটাকে রেখে চলে যাচ্ছেন এবং উনি যখন চলে যাচ্ছেন, তখন বুঝতে পারলাম উনি একজন মহিলা। তার পড়নে একটি হলুদ শাড়ি। আমি যেন ভেতর থেকে অনেকটা অবাক হলাম। ওনাকে আমার অনেক পরিচিত একজনের মত লাগল। আমি ভাবলাম, ওনাকে থামাব। তারপর ভাবলাম আমার মেয়েকেই আগে জিজ্ঞাস করি। যখন আমি ওর কাছাকাছি চলে এসেছি. তখনো আমার মেয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, মা, ওনাকে তুই চিনিস? আমার মেয়েটা মিটিমিটি হেসে মাথা নাড়ে। ঐ হাসিটার মত এত সুন্দর হাসি আমি কখনো দেখিনি। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখি, ওকে জিজ্ঞাস করলাম, উনি কে? আমার মেয়ে বলল, মা।

চলবে…….