বুধবার, ০১ মে ২০২৪

শিরোনাম

কর্ণফুলী টানেল: নৈসর্গিক চট্টগ্রামের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের পালকে অনন্য সংযোজন

বুধবার, অক্টোবর ২৫, ২০২৩

প্রিন্ট করুন
মো. রেজাউল করিম চৌধুরী

মো. রেজাউল করিম চৌধুরী: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্রতায় ভরা চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অনন্য সাধারণ জেলা। এ জেলার পাহাড়, সমুদ্র, সমতল ও স্বচ্ছ নদ নদীর সমম্বিত সৌন্দর্য যে কাউকে সহজে মুগ্ধ করে। কেবল সৌন্দর্যে নয়, প্রাচুর্য্যওে চট্টগ্রামকে ভরপুর করে দিয়েছে প্রকৃতি। এ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্ণফুলি তার, স্নিগ্ধতা, চঞ্চলতা ও মাধুর্যের কারণে তো বটেই, বরং তারও চেয়ে অধিক গুরুত্ব বহন করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। দেশের আমদানি রপ্তানির সিংহভাগই পরিচালিত হয় এ বন্দর দিয়ে। চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে কুলু কুলু ধ্বণি তুলে বয়ে চলা সদা চঞ্চল কর্ণফুলি চট্টগ্রামকে দুই অংশে বিভক্ত করেছে। এর এক দিকে রয়েছে বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম মহানগর ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আর অন্য দিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা। চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশের সাথে মহানগর, উত্তর ও দেশের অন্যান্য জেলার সাথে সড়ক যোগাযোগের যে মাধ্যম ছিল, তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলটি সেই অপর্যাপ্তটা অনেকটাই ঘোচাতে পারবে।

এক সময় কালুরঘাট রেল সেতুকেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে অন্য অংশের একমাত্র সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হত। এরপর চাক্তাই-শিকলবাহা অংশে স্টীলের স্পেনের উপর বসানো কাঠের সেতু দিয়ে হাল্কা ও মাঝারি যানবাহন দুই পারে পারাপার করত। ২০১০ সালে শেখ হাসিনা ঐ অংশে কাঠের সেতুর পরিবর্তে কংক্রিটের তৈরি শাহ আমানত-কর্ণফুলি তৃতীয় সেতু উদ্বোধন করলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। হালকা, মাঝারী ও ভারী যে কোন ধরণের যানবাহন এখন এই সেতু দিয়ে সহজে পারাপার হতে পারে বলে, বিগত দশকে পশ্চিম পটিয়া ও কর্ণফুলি এলাকায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের মাধ্যমে রূপান্তরের সোনালী গল্প রচিত হয়েছে।

ওয়ান সিটি টু টাউনের পথে হাটছে ঐশ্বর্যের চট্টগ্রাম, যে স্বপ্ন নিয়ে চট্টলার অবিসংবাদিত নেতা, চট্টগ্রাম সিটির সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাকে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। নানা জটিলতায় এটি থমকে গেলে, চট্টগ্রামের আরেক অবিসংবাদিত নেতা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু পটিয়া উপজেলার অধীনে থাকা কর্ণফুলী তীরবর্তী ইউনিয়নকে নিয়ে পৃথক উপজেলা গঠন করে দ্রুত উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন। দূরদর্শী এ জননেতার মৃত্যুর পর তার সন্তান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ঐ এলাকার সাংসদ নির্বাচিত হন এবং পর্যায়ক্রমে ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও ভূমি মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টির কারণে কর্ণফুলি তীরবর্তী পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে কর্ণফুলি উপজেলা গঠিত হয়। আধুনিক নগরের সাজে সাজতে থাকে উপজেলা কর্ণফুলী। পাশাপাশি, সারা দেশে ১০০টি বিশেষ শিল্প এলাকা গঠন করার ঘোষণার প্রেক্ষিতে আনোয়ারায় গড়ে ওঠছে চায়না ইকোনোমিক জোন, কর্ণফুলি ও আনোয়ারার অংশে গড়ে ওঠেছে কোরিয়ান ইপিজেড। এক ঘন্টার কাজ সারার জন্য জোয়ারভাটা হিসেব করে দুই দিনের সময় নিয়ে যে বাঁশখালীর মানুষদের এক সময় চট্টগ্রাম শহরে আসতে হত, তারাই এখন কাজের জন্য সকালে শহরে এসে সারা দিনের কাজ শেষ করে রাতে বাড়ী ফিরে ঘুমাতে পারে। তাছাড়া, স্বয়ং বাঁশখালীতে লেগেছে শিল্পায়নে ছোঁয়া-গড়ে ওঠেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এগো ফার্মসহ ছোট ছোট কারখানা। তবুও কিছুটা জটিলতা রয়েই গিয়েছিল। উত্তরের জেলাগুলোর যানবাহনকে দক্ষিন চট্টগ্রামসহ পর্যটন শহর কক্সবাজার, বান্দরবান ও টেকনাফে যেতে হলে চট্টগ্রাম শহরের উপর অনেক ঘুরতি পথে শাহ আমানত সেতু হয়েই যেতে হয়। ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ এ জটিলতাকে সহজেই নিরসণ করতে সক্ষম হবে।

কর্ণফুলির উপর ভেসে থাকা নৌযান ও মাঝি মল্লা, পণ্য নিয়ে বিদেশ থেকে আসা পণ্য বোঝাই জাহাজের নাবিক ও ক্রুসহ সংশ্লিষ্টজনেরা এবং দুপারে স্থানীয় বাসিন্দারা পর্যন্ত এতটুকু আঁচ করতে পারেনি কর্ণফুলির তলদেশের আরো ১৫০ ফুট গভীরে উন্নয়নের কি মহোৎসব চলেছে। বিশাল আকৃতির অত্যাধুনিক টানেল বোরিং মেশিন দিয়ে সুরঙ্গ তৈরি করে বিশেষ সেগমেন্ট দিয়ে করা হয়েছে দুটি বড় বড় টিউব, টিউবের ভেতর করা হয়েছে পীচঢালা পথ। এ মহা কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের পর সংযোগ সড়কের কাজ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং এর নান্দনিকতা সকলকে মুগ্ধ করেছে। একইভাবে মূল শহরের বাসিন্দারা টেরও পাবে না উত্তরের জেলা গুলো থেকে চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণাংশে পতেঙ্গা হয়ে আনোয়ারা প্রান্ত দিয়ে দৈনিক হাজার হাজার গাড়ী যাতায়াত করবে, আর স্রোতস্বীনী কর্ণফুলীর জলও টের পাবে না কত ব্যস্ত থাকবে তার নীচ দিয়ে নির্মিত সড়ক। এ ধরনের অসাধ্য সাধনের সাহসিকতা এ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় আর কেউ দেখাতে পারেনি। শেখ হাসিনার পক্ষেই এ সাহসিকতা দেখানো সম্ভব। তিনি দেখিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা সহায় থাকলে, জনগণ পাশে থাকলে এবং সৎসাহস ও আন্তরিকতা থাকলে প্রমত্ত পদ্মার তলদেশ থেকে স্তম্ভ তুলে এনেও সেতু ও রেলপথ বানানো যায় আবার স্রোতস্বীনী কর্ণফুলির তলদেশেরও অনেক গভীরে গিয়ে সুরঙ্গ পথ তৈরি করে এপাড়-ওপাড় এক করা যায়।

আগামী ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলির তলদেশ দিয়ে নির্মিত ‘কর্ণফুলী টানেল’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান টানেল) উদ্বোধনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির মুকুটে নতুন স্বর্ণময় পালক গুঁজে দিতে চট্টগ্রাম আসছেন শেখ হাসিনা। এ টানেল দিয়ে নদী পার হয়ে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য খুলে দিবেন আরেকটি স্বপ্নদুয়ার। সাংহাইয়ের আদলে কর্ণফুলীর দুই পাড়ে দ্রুত গড়ে ওঠবে ওয়ান সিটি টু টাউন। কমে আসবে পার্বত্য বান্দরবান, কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিনের সাথে চট্টগ্রামের উত্তরের জেলা গুলোর দূরত্ব, বাঁচবে জ্বালানী খরচ ও শ্রমঘন্টা। দেশের পর্যটন শিল্পে পড়বে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব, আসবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এশিয়ান হাইওয়ের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আনবে অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন।

বঙ্গবন্ধু টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী টানেলপথ পাড়ি দিয়ে আনোয়ারার কেইপিজেড মাঠে জনসভায় যোগ দিবেন ও জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। আজ মনে পড়ছে, সেই জনসভার কথা। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির ময়দানে জনসভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি যদি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান, তবে চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিজ হাতেই করবেন। তিনি তার কথা রেখেছেন। চট্টগ্রামকে তিনি রূপান্তরিত স্বপ্নের চট্টগ্রামের পথে নিয়ে গেছেন, দিন বদলের সনদ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত এক বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে হাজির করেছেন।

বিশ্ব বাংলাদেশকে জানত একটি ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ প্রাকৃতিক বৈরির দেশ, ঝড়, খরা, বন্যা, মঙ্গা ও দারিদ্রপীড়িত হাহাকারের দেশ হিসেবে। শেখ হাসিনা তার দুরদর্শী নেতৃত্ব ও অদম্য ইচ্ছা শক্তি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন। বিশ্বসভায় শেখ হাসিনা একজন অত্যন্ত সম্মানের আসন তৈরি করে নিয়েছেন, দেশকে দিয়েছেন উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। জিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে উন্নত, সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মহাসড়কে আছি এখন আমরা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের রায়ে ফের যদি আমরা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আনতে পারি, তবে অচিরেই বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাতারে পৌঁছে যাবে- এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

পরিশেষে, শেখ হাসিনার প্রতি অভিবাদন জানিয়ে ও চট্টগ্রামসহ দেশের জনগণকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে শেখ হাসিনাকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করার আহ্বান জানাই। সবাইকে ধন্যবাদ-জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন
জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।