রবিবার, ০৫ মে ২০২৪

শিরোনাম

চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্পের সম্ভাবনা-অগ্রগতি ও পরিবেশ ভাবনা

মঙ্গলবার, জানুয়ারী ১৭, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

মো. নুরুল কবির: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প পুরো বিশ্বে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। আদতে যেসব পণ্যবাহী বা যাত্রীবাহী জাহাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, সেসব জাহাজের মালিকেরা ওই জাহাজগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তা বিক্রি করে। একটি হিসেবে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় গড়ে ৬০০টি পুরানো জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার মত দেশগুলোতে কাটা হচ্ছে। মূলত জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকে কেন্দ্র করে এসব দেশের সমুদ্র সৈকতগুলোতে গড়ে উঠেছে বড় বড় রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি।

তেমনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জেলা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় জাহাজ ভাঙা শিল্পের এলাকা সম্প্রসারিত হয়েছে। জাহাজ ভাঙার শিল্প এক দিকে অর্থনীতিতে প্রভাবিত ফেলছে, অন্য দিকে, পুরো বাস্তুসংস্থানের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে; বিশেষ করে পরিবেশ বিপর্যয় ভাবিয়ে তুলছে।

১৯৬০ সালের শুরুতে গ্রীক জাহাজ এমডি আলপাইন নামের একটি জাহাজ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতে বিকল হয়ে পড়ে। ওই জাহাজটিকে এলাকার মানুষ ও চট্টগ্রাম স্টিল মিলের শ্রমিক একত্রিত হয়ে রশি দিয়ে টেনে সমুদ্র তীরে নিয়ে আসে। বিভিন্ন নির্মাণ কাজে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করার লক্ষ্যে জাহাজটিকে ভাঙ্গার মাধ্যমে বাংলাদেশ এক নতুন শিল্পে প্রবেশ করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জাহাজ আল আব্বাস বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরে উদ্ধার করে ফৌজদারহাট সমুদ্র তীরে আনা হয়।

১৯৭৪ সালে কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কশপ লিমিটেড এটিকে কিনে নেয় ও বাংলাদেশে বাণিজ্যিক শিপ ব্রেকিং চালু করে। বাংলাদেশের জাহাজ শিল্প মূলত চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে জাহাজ শিল্পের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

বিভিন্ন তথ্য মতে, আমাদের দেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পে প্রায় ৬০-৭০ হাজার লোক সরাসরি কর্মরত। আরো ৩০ লাখ পরোক্ষভাবে এ ব্যবসায়ে জড়িত। জাহাজের আকারের ওপর ভিত্তি করে ৩০০-১০০০ লোক অস্থায়ী ভিত্তিতে একটি জাহাজ ভেঙে ফেলার জন্য নিযুক্ত করা হয় ও আরো অনেককে জাহাজ থেকে সব ধরনের উপকরণ পুনর্ব্যবহারের জন্য ক্রিয়াকলাপে নিযুক্ত হয়।

পুনর্ব্যবহারযোগ্য কিছু সামগ্রী রফতানি করা হয় ও বাকিগুলো বিক্রি হয় বা বাংলাদেশে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। অনেক উপকরণ স্থানীয় অর্থনীতির জন্য উচ্চ মূল্যবান। বিশেষ করে নির্মাণের জন্য লোহার রড, নতুন জাহাজের প্লেট বা অন্যান্য অনেক কাজের জন্য ইস্পাতের পুনর্ব্যবহার একটি লাভজনক ব্যবসায়। চট্টগ্রামের উত্তর উপকূলে।

দেশে প্রায় ১৫৮টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে, এর মধ্যে ৩০-৪০টি সারা বছর সক্রিয় থাকে। জাহাজ ভাঙা দেশের স্টিল মিলের কাঁচামালের প্রধান উৎস। বর্তমানে বাংলাদেশের স্টিলের প্রচুর চাহিদা আছে। বাংলাদেশে লোহার কোন আকরিক উৎস বা খনি নেই। এ জন্য জাহাজ ভাঙা কাঁচামাল অনিবার্য ও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ফলে ইস্পাত সামগ্রীর কাঁচামাল আমদানি কমিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে ৩৫০টির বেশি ছোট-বড় স্টিল রি-রোলিং মিল রয়েছে ও তাদের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে জাহাজের স্ক্র্যাপ ব্যবহার করা হয়।

এ শিল্প থেকে প্রতি বছর ৩০-৩৫ লাখ টন স্ক্র্যাপ পাওয়া যায়, যা বর্তমানে স্থানীয় ইস্পাত শিল্পের ৭০ শতাংশের বেশি কাঁচামাল সরবরাহ করছে। এ ছাড়া, স্থানীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পও মূলত এর ওপর নির্ভর করে। কারণ, এর কাঁচামালের বেশির ভাগই স্ক্র্যাপ স্টিল থেকে ব্যবহূত হচ্ছে। জাহাজ ভাঙা শিল্পের ওপর নির্ভর করে এরই মধ্যে ভারী ও হালকা প্রকৌশলসহ বেশ কয়েকটি স্থানীয় শিল্প গড়ে উঠেছে, যেমন জাহাজ নির্মাণ শিল্প।

এ শিল্প প্রতি বছর বিভিন্ন কর প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করে। প্রতি বছর সরকার আমদানি শুল্ক ও অন্যান্য করের মাধ্যমে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে প্রতি বছর এক হাজার ২০০-এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করে। আমাদের দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রায় ৪৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ বিশ্বের অব্যাহতিপ্রাপ্ত জাহাজ ভেঙে বিশ্ব বাজারে শীর্ষ স্থান দখল করেছে।

২০২২ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারত ৩০.৫ শতাংশ, পাকিস্তান ২০.৫, তুরস্ক ২.৩ ও চীন ২ শতাংশ জাহাজ ভেঙেছে। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থ বছরে ভারত শীর্ষ স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচালিত জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানীয় দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এ শিল্পে আরো বেশি আধুনিক করা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি সব থেকে বেশি আলোচনায় রয়েছে।

নদীতে কালচে পানি হওয়ায় অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। জলজ সব উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে না কোন প্রকারের মাছ। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও বেড়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে ২০টির অধিক শিপইয়ার্ড রয়েছে। তবে এগুলোকে গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত করার কথা থাকলেও খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাদ দিয়ে জাহাজ ভাঙ্গার জন্য আধুনিক মেশিন ব্যবহার করা জরুরী। স্ক্র্যাপ ওঠানামার জন্য সবগুলো ইয়ার্ডে ম্যাগনেট ক্রেন ব্যবহার করা দরকার। জাহাজ ভাঙার শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

তবে জাহাজ আনার ক্ষেত্রে আগাম কর প্রদান করার সরকারি নীতিমালার থাকলেও আগাম কর ফেরতযোগ্য হলেও দুই বছর ধরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মত আগাম কর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আটকে আছে। এ কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিপ ব্রেকিং শিল্পটি ও ফলে গত বছর জাহাজ আমদানির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে। দেশের ধারাবাহিক কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগর শাখা।