সোমবার, ০৬ মে ২০২৪

শিরোনাম

শবে বরাত ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ রাতে করণীয়-বর্জনীয়

সোমবার, মার্চ ৬, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: হিজরি ১৪৪৪ বর্ষ পরিক্রমা বা চান্দ্র মাসের অষ্টম মাস শাবান মাস। মঙ্গলবার (৭ মার্চ) দিবাগত রাত হল ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’। আর ইসলামি তমুদ্দুন তথা মুসলিম কৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে একটি হল শবে বরাত’। শবে বরাত শব্দটি ফারসি। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী। এর আরবি হল ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিস শরিফে একে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্যরাত বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই পরিচিত। আল্লাহ বলেন, ‘হা মীম! শপথ! স্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হল আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন।আ র যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে শবে বরাত-খ্যাত রাতটি হাদিসে ঘোষিত ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ ভাগ্য রজনী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। অথচ হাদিসের বর্ণনায় এটি ক্ষমা কিংবা মুক্তির মাস।

কাঙ্ক্ষিত এ রাতটি নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ির শেষ নেই। আবার এ রাতটি একেবারেই মর্যাদাহীন বলেও অনেকে মাত্রাতিরিক্ত ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত হয়। আসুন সংক্ষেপে এ রাত সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিই-

শবে বরাতের ফজিলতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলা ঠিক নয়। কারণ, দশজন সাহাবি থেকে শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং, শবে বরাতের ফজিলত ও রাতের ইবাদতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তথা বিদয়াত বলা কোনক্রমেই সঙ্গত নয়। বরং, বাস্ততার আলোকে স্বীকার করতেই হবে, এ রাত পূণ্যময় মুক্তির রাত। এ রাতে জেগে থেকে নফল ইবাদত-বন্দেগি করা পূণ্যময় কাজ। তবে, ইসলামে এ রাতের ইবাদতের জন্য বিশেষ কোন নিয়মনীতি নেই।

শবে বরাত কী? দুইটি শব্দ। একটি আরবি (লাইলাতুল বারাআত) অন্যটি ফার্সি (শবে বরাত)। আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ শব্দ দুটির অর্থ হল- মুক্তির রাত। আর ফার্সিতে ‘শবে বরাত’ শব্দ দুটির অর্থ দাড়ায় ‘ভাগ্য রজনী’। কিন্তু, হাদিসের পরিভাষায় এ রাতটি ব্যবহৃত হয় ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত। সুতরাং, এ রাতটিকে শবে বরাত কিংবা লাইলাতুল বারাআত না বলে হাদিসে ব্যবহৃত ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ বললে বা নামকরণ করলেই তা সুন্দর হয়। তাতে আদায় হবে পরিপূর্ণ সুন্নাত ও সবার কাছেই হবে গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া, নামকরণে বিভেদ কিংবা মর্যাদায় অতিরঞ্জন ও ছাড়াছাড়ি না করে হাদিসের ওপর আমল করাই জরুরি বিষয়।

হিজরি সালের অষ্টম মাস শাবানে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার ব্যাপারে হাদিসের নির্দেশনা রয়েছে। আর এ মাসের ১৪ তারিখ সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ বা শবে বরাত।

হাসান হাদিসের বর্ণনায় এটি বিশেষ ক্ষমার রাত হিসেবে পরিচিত। এ রাতের রিজিক চাওয়ার ব্যাপারেও হাদিসের বর্ণনা এসেছে। তবে, এ হাদিসকে অনেকে মাওজু বলেছেন। হাদিসের দুর্বল বর্ণনার পাশাপাশি বিশুদ্ধ বর্ণনায় ক্ষমা ও গোনাহ মাফের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ওঠে এসেছে হজরত আবু মুসা আল-আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত তার সৃষ্টির সবাইকে ক্ষমা করেন।’ (ইবনে মাজাহ)

হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) (বিছানায়) না পেয়ে তার খোঁজে বের হলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি জান্নাতুল বাকিতে। তার মাথা আকাশের দিকে তুলে আছেন। তিনি বলেন, ‘হে আয়েশা! তুমি কি আশঙ্কা করেছো যে, আল্লাহ ও তার রাসুল তোমার প্রতি অবিচার করবেন?’ আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তা নয়, বরং আমি ভাবলাম যে, আপনি হয়তো আপনার কোন স্ত্রীর কাছে গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার কাছাকাছি আকাশে অবতরণ করেন ও কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চাইতেও অধিক সংখ্যক লোকের গোনাহ মাফ করেন।’ (ইবনে মাজাহ)

সুতরাং, হাদিসের দিকে লক্ষ্য রেখে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার মাস শাবানের মধ্য রাতের ইবাদত ও ক্ষমা পাওয়ার বিষয়ে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি না করাই উত্তম। নিজ নিজ ঘরে কিংবা একাকি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে নিজেদের গোনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’।

সবার মনে রাখতে হবে, শাবান মাসজুড়ে রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। হাদিস শরিফে এ ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী করিমকে (সা.) শাবান মাসের মত এত অধিক (নফল) রোজা আর অন্য কোন মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প কয়েক দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৭) এছাড়াও, ‘আইয়ামে বিজ’ বা প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার ব্যাপারেও হাদিস শরিফে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটা রাসুলের (সা.) সুন্নত।

১৫ শাবান শবে বরাত। একটি হাদিসে এ রাত পরবর্তী দিনে রোজা রাখার নির্দেশনা রয়েছে। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘১৫ শাবানের রাত যখন হয়, তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে পালন করো ও দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোন রিজিক অন্বেষণকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। আছে কি কোন রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮

লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ রাতে কিছু বর্জণীয় আমল: ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ উপলক্ষে পরিবারের জন্য বিশেষ খাবারের আয়োজনের মধ্যমে সারা বছর ভালো খাবার পাওয়ার বিশ্বাস ও আয়োজন থেকে বিরত থাকা। ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ এ আনন্দ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে মারাত্মক শব্দ দুষণের হাতিয়ার ফটকা ও আতশবাজী ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা। ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’এ গোনাহ মাফের নিয়তে সন্ধ্যা রাতে গোসল করা থেকে বিরত থাকা। ঘরে, আঙিনায়, কবরে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো ও গোলাপজল ছিটানো থেকে বিরত থাকা। ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’এ বাড়ি ঘর আলোকসজ্জা, কবরস্থানে আলোকসজ্জা ইত্যাদিও পরিহার করা আবশ্যক। কারণ, শবে বরাতের নামে ইসলামে এ সব মারাত্মক সীমালঙ্গন। তা কোনভাবে বৈধ নয়।

পরিশেষে, শবে বরাত উপলক্ষে নফল রোজা রাখা, নফল নামাজ পড়া, কেরাত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা; কোরআন তেলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি পাঠ করা, ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; ফজিলতপূর্ণ বিভিন্ন দোয়া, তাসবিহ-তাহলিল ও জিকির-আজকার ইত্যাদি করা। সম্ভব হলে কবর জিয়ারত করা, নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সব মুমিন-মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা ও হাদিসের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। সুন্নাহ বহির্ভূত কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। এ রাত সম্পর্কে বিতর্ক, বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ইসলামী গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।